জামাত- শিবিরের নৃশংসতায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার ২৫ বছর আজ ।
অভিশপ্ত ২২ ফেব্রুয়ারী আজ। ২৫ বছর আগে ২০০০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী রাতে দক্ষিন ফেঞ্চুগঞ্জ মাইজগাঁও বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ৭১ এর পরাজিত শক্তি জামাত- শিবির এর ঠান্ডা মাথার পরিকল্পিত নির্মম পৈশাচিকতার শিকার হয়েছিলাম আমি। ঘাতক গোষ্ঠী আমার হাত পায়ের রগ কেটে ও সারা শরীরে কুপিয়ে মৃত ভেবে উল্লাস করে ফেলে যায়। দীর্ঘ চিকিৎসার পর আমি বেঁচে গেলেও পরিপুর্ন সুস্থ হতে পারিনি। অনেকটা পঙ্গু জীবন যাপন করতে হচ্ছে আমাকে। একটি ইসলামী দলের নেতাকর্মী হয়ে ইসলাম ধর্ম সমর্থন করেনা এমন অপকর্ম ও কাপুরুষোচিত কাজ কতটা ঠান্ডা মাথায় ও নিষ্ঠুরতম উপায়ে করতে পারে তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ শিবির নামক পিশাচেরা, আর তার জীবন্ত স্বাক্ষী আমি। ভেবেছিলাম মানুষ ভুল করলে উপলব্ধি করতে পারলে সত্য মেনে নিয়ে ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়ে শুধরায়। কিন্তু আমি অবাক বিস্ময়ে লক্ষ্য করলাম ইদানিং বড় গলায় বলে বেড়াচ্ছে তারা নাকি কারো হাত পায়ের রগ কাটেনি, রগ কাটার রাজনীতিতে তারা বিশ্বাস করেনা। তাহলে আমার সবিনয় প্রশ্ন, আমার হাত পায়ের রগ কাটলো কে? আমি নিজেই কি আমার হাত পায়ের রগ কেটে ফেললাম? নাকি জ্বীন-ভূতে এসে কেটে গেলো? আমার প্রশ্ন আমি আহত হওয়ার পর ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা শিবিরের কমিটি বিলুপ্ত করা হয়েছিল কেন?

কাউকে আঘাত কিংবা হেয় করার জন্য নয় বরং প্রকৃত সত্য এ প্রজন্মকে জানানোর জন্য আমার এই লেখা। আমি তখন সিলেট জেলা ছাত্রদলের কার্যনির্বাহী কমিটির সিনিয়র সদস্য ও ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির ছাত্র বিষয়ক সম্পাদক। স্থানীয় ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের মধ্যে তখন মারাত্মক বিরোধ ছিল। ৯৯ সালের ১১ জুলাই ফেঞ্চুগঞ্জ সরকারি কলেজে সংগঠিত সংঘর্ষের জের ধরে দু’পক্ষের হামলা – পাল্টা হামলায় অনেকেই গুরতর আহত হয়। এক পর্যায়ে আমি আহত হওয়ার মাত্র দুই দিন পুর্বে সাবেক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান ও বর্তমান জামাতে ইসলামের আমীর ( ততকালীন সিলেট মহানগর জামাতের আমীর) ডাঃ শফিকুর রহমান সহ বিএনপি ও জামাত নেতৃবৃন্দের মধ্যস্ততায় ছাত্রদল – শিবির এর বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। ছাত্রদল – শিবির বিরোধ নিষ্পত্তির ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আমাকে পরিকল্পিত ভাবে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করে হাত পায়ের রগ কর্তন করে সারা শরীরে কুপিয়ে মৃত ভেবে কাপুরুষের মতো চলে যায় শিবির। বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়ার আগে যদি শিবির যদি আমাকে মেরেও ফেলতো আমার কোন আপসোস বা দুঃখ ছিলোনা। আমার দুঃখ এবং কষ্ট এই জায়গায় একটি ইসলামি দলের নেতাকর্মী হয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আমার প্রতি যে জুলুম ও বর্বরতা প্রদর্শন করলো তা মোনাফেকি ও বেঈমানী ছাড়া আর কিছু নয়।
তোরা ভেবেছিলো আমাকে মেরে ফেলেছিস কিন্তু আমার আল্লাহ আমাকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছেন তোমাদের ভণ্ডামির মুখোশ উন্মোচন করার জন্য। আমার মা,বাবা, ভাই, বোন পরিবার পরিজন, দলীয় নেতাকর্মী, শুভাকাঙ্ক্ষীদের চোখের পানি ও দোয়া ছিলো বলে এখনো আল্লাহতালা আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
কঠিন ঐ সময়ে আমার পাশে থাকা আমার বড় মামা মরহুম মনির উদ্দিন আহমদ, ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মরহুম আজমল আলী, আনোয়ারুল করিম চৌধুরী লালু মিয়া ও মিনহাজুল ইসলাম চৌধুরী এখলাস চাচা সহ অনেকেই আজ দুনিয়াতে নেই। আল্লাহ যেন তাদেরকে জান্নাতবাসী করেন। ঐ দিন রাতে ওসমানী মেডিকেল কলেজ ছাত্রদলের যেসকল ভাই, বোন ও এলাকার যারা রক্ত দিয়ে ও বিভিন্ন ভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের প্রতি আমি আমৃত্যু কৃতজ্ঞ থাকবো।
নোংরা রাজনীতি ও কিছু কথা —–
আমার জীবনে বয়ে যাওয়া ঝড় আমাকে এখনো কাঁদায়, এখনো ভাবায়। কেন এমন হলো? সমঝোতার নামে আমাকে কি মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়ে নিজেরা কি বাঁচার নাটক মঞ্চায়ন করেছিলো। আর সরল বিশ্বাসে তা বিশ্বাস করে বলির পাঠা হয়েছিলাম আমি।
আমি আহত হওয়ার আগে শিবিরের হাতে আহত হয়েছিল সহযোদ্ধা সুফি, রুহেল, আসাদ, সুমন, আম্বিয়া, সহ ৮/১০ জন।
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার কিছুদিন পর অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী মরহুম এম সাইফুর রহমান এর এপিএস সাহেব নিজে থেকে আমাকে জানান আমাদের আহত সহযোদ্ধাদের একটি তালিকা ও উন্নত চিকিৎসার জন্য দরখাস্ত প্রধানমন্ত্রী বরাবরে দেওয়ার জন্য। তিনি তা অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীকে দিয়ে সুপারিশ করিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠাবেন। তার এই মহতি।চিন্তাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে আমি সহ নেতাকর্মীদের দরখাস্ত রেডি করে ঢাকায় গিয়ে তার নিকট দেই। দরখাস্ত গুলো তিনি তার গাড়ির সামনের বক্সে রাখেন। ৬/ ৭ মাস পর থাকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আমাকে বলেন বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রীর সুপারিশ সহ প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠানো হয়েছে। যে কোনো সময়ে আমাদেরকে তলব করা হবে। এলাকার বড় ভাই হিসেবে আমি তা সরলমনে বিশ্বাস করি। সুফি সহ সহকর্মীরা আমাকে এ বিষয়ে জানতে চাইলে আমি তাদেরকে বলি বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। সহযোদ্ধা সুফি, টিপু ও মিটু তখন গুলশানে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান করার সুবাদে বাড্ডায় বসবাস করতো। একদিন সুফি ফোন করে জানতে চায় আমাদের দরখাস্ত গুলোর কি অবস্থা। আমি তাকে আবারো বলি বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। তখন সুফি রাগে, ক্ষোভে উত্তেজিত কন্ঠে আমাকে বলে দরখাস্ত গুলো দিয়ে সে জুতা মুছে বাড্ডার ডাষ্টবিনে ফেলে যাচ্ছে। আমি অবাক ও কিং কর্তব্য বিমুঢ় হয়ে পড়ি। আমি তার কাছে জানতে চাই ঘটনা কি? প্রতিউত্তরে যা শুনি তা শুনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সে আমাকে জানায় গুলশানে তার সাথে এপিএস সাহেবের দেখা হলে সে তাকে সালাম দেয়। কুশলাদি বিনিময়ের পরে জানতে চান সে কোথায় যাবে। বাড্ডা যাবে শুনে গাড়িতে উঠতে বলেন। বাড্ডা গিয়ে গাড়ি থেকে নামার সময় তার পা কাঁদার মধ্যে পড়ে যায়। সে গাড়ির বক্সে টিস্যু খোঁজতে গিয়ে আমাদের নাম লেখা সেই খামগুলো দেখতে পায় এবং সেগুলো নিয়ে নেমে পড়ে। ময়লাযুক্ত খাম খুলে আমাদের দরখাস্ত গুলো দেখতে পেয়ে রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে, অপমানে নিজের জুতা মুছে ঐ গুলো ডাষ্টবিনে ফেলে দেয় । আার এভাবেই ভেঙ্গে যায় বিশ্বাস ভঙ্গের গল্প। আস্থা ও বিশ্বাসের বদলে তৈরি হয় ঘৃণা। যা আজও বহমান। যতদিন এ দেহে প্রান থাকবে ততদিন এ ঘৃণা আমার বাড়তেই থাকবে। মানুষ মানুষের সাথে কেন এমন করে?
একটা মানুষ কতটা নিষ্টুর, অমানবিক ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হলে নিজের সহকর্মী ছোট ভাইদের সাথে এমন নিষ্ঠুরতম তামাশা করতে পারে।
আজ ২৫ বছর পর কেন জানি মনে হচ্ছে তাহলে আপোসের মধ্যেও কি কোনো সুগভীর ষড়যন্ত্র লুকায়িত ছিলো।
জামাত – শিবিরকে এবং কিছু মানুষকে আমি মনেপ্রাণে কেন ঘৃণা করি এ লেখা পড়ার পর এ প্রজন্মের যারা এই নিষ্ঠুরতার গল্প জানতেন না তারা আশাকরি আমাকে ভুল বুঝবেন না।
রাখে আল্লাহ মারে কে,
যতদিন বেঁচে থাকবো সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলাবোই বলবো.
আল্লাহ যেন আমাদেরকে হেদায়েত নসিব করেন।
লেখাটি আব্দুল আহাদ খান জামাল
এর ফেসবুক থেকে সংগৃহীত