একজন জাইমা ও শুয়োরমানবদের রাজনীতি

২০১৯ সালের ৫ই জুন। ওভালে চলছে বাংলাদেশ-নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট ম্যাচ। বিশ্বকাপের আসর। গ্যালারিতে বসে খেলা দেখছিলাম। একই সারিতে কাছাকাছি দূরত্বে বসা মেয়েটির গালে বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা। সারা শরীর ঢাকা লাল-সবুজের পতাকায়। কখনো কখনো সেটি মাথায় উঠে আসছে স্কার্ফের মত করে। বাংলাদেশের পারফরমেন্স একটু ভালো হলেই উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে মেয়েটি। মাশরাফি-সাকিব-তামিমদের চার-ছক্কা, উইকেট লাভে শিশুদের মত লাফাচ্ছে, হাততালি দিচ্ছে, সহপাঠীরাসহ খেলোয়াড়দের নাম ধরে চিৎকার করছে। মেয়েটির কলধ্বনি, অঙ্গভঙ্গি বলে দিচ্ছিলো সে পিতৃভূমিকে ভালোবাসে। বিলেতি আলো-বাতাসের ছোঁয়া লাগলেও সে ভুলেনি, তার শিকড় বাংলাদেশে। মেয়েটি শিকড়ের টান অনুভব করে। সুশ্রী-মার্জিত, রুচিশীল পোষাকের তরুণী মেয়েটির দেশপ্রেম উপস্থিত দর্শকদের হৃদয় কেড়ে নিচ্ছিলো। আমার হঠাৎ মনে হল, মেয়েটি নয়, গ্যালারির কিঞ্চিৎ জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একখণ্ড বাংলাদেশ। আমি অভিভূত।
লন্ডনের সকালটা আজ অপূর্ব। হাঁড় কাঁপানো শীত পড়লেও আলোঝলমলে দিন, নীল আকাশ, মোলায়েম বাতাস। আমার ফ্ল্যাটের জানালা দিয়ে থেমস নদী ও শান্ত লেকের তরঙ্গমালা দেখা যায়। এমনসব সকালে জানালাঘেঁষা সোফায় প্রাতরাশ ভক্ষণ করতে করতে বাইরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে পছন্দ করি আমি। কিন্তু আজ মেজাজ খিঁচড়ে আছে। ভোরে ঘুম ভেঙেছে মেসেন্জারে একটি ভিডিও ক্লিপ পেয়ে। পরিচিত একজন পাঠিয়েছেন। স্তব্ধ-হতভম্ব হয়ে গেলাম। এত নিকৃষ্ট-নোংরা খিস্তিখেউড় কারো মুখ থেকে বের হতে পারে, আমার কল্পনাতেও ছিলো না। শুধু আমি কেন, মাতৃগর্ভের ভ্রুণ হতে পৃথিবীতে আসা কোন মানবসন্তানই বোধ হয় কথাগুলো হজম করতে পারবে না। সোশ্যাল মিডিয়ার কনটেন্টস অনেক সময় এডিটেড কিংবা ট্যাম্পার্ড হয়, সে চিন্তা থেকে ভিডিওর মূল উৎস খুঁজে বের করলাম। অখ্যাত-অভদ্র-বেয়াদব এক পুঁচকে হোস্টের পরিচালনায় ঘন্টাখানেকের একটি তামাশা শো, অতিথি ‘তথ্য প্রতিমন্ত্রী’ পদধারী এক ব্যক্তি।
দেশে এখন অবৈধদের রাজত্ব চলছে। চারদিকে অবৈধদের উৎপাত। এদের পদ অবৈধ, ক্ষমতা অবৈধ, কর্মকাণ্ড অবৈধ, কারো কারো জন্মও। যে ভাষায় এরা কথা বলে, যে অঙ্গভঙ্গি ব্যবহার করে, যে সুরে ধমক দেয়, তা সহ্য করতে হলে দেবতা হতে হয়। আমি দেবতা না। বেজন্মাটার কথা শোনার পর থেকে সব তেতো লাগছে। রাগ চড়ছে। কিচেনে গিয়েও ফিরে এলাম, নাশতায় রুচি নেই। ভাবলাম, অফিসে চলে যাই, দু’চার ঘন্টা কাজের মধ্যে থাকলে মাথা ঠাণ্ডা হবে। শনিবার ব্যাডমিন্টন খেলি। সেটাও বাদ দিলাম। অফিসে যাওয়ার পথে ভুল ড্রাইভ করে হর্ন খেলাম। পশ্চিমের দেশ সম্পর্কে যাদের অভিজ্ঞতা বা ধারণা আছে তারা জানেন, পেছন থেকে হর্ন খাওয়া এসব দেশে বিরাট অসম্মানের। বুকে চাপ বাড়ছে। টের পাচ্ছি, শিরদাঁড়া বেয়ে নামছে আগুনের হল্কা। অ্যাড্রিনালিন ও এরঅ্যাড্রিনালিনের প্রভাবে মস্তিষ্কের লিম্বিক সিস্টেম নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অফিসের ফাইলে মন বসছে না। লেখায় হাত দিলাম।
মেয়েটির কথায় ফিরে আসি। তার বয়েস যখন আঠারোর কাছাকাছি, তখন থেকেই তাকে চিনি। মায়াকাড়া চেহারা, সাদাসিধে চলনবলন। আচরণে কোন গরিমা নেই। দেখা হলে বাবার সহকর্মীদের ‘আঙ্কেল’ বলে মিষ্টি করে সালাম দেয়। তাদের বাসায় যখন যেতাম, দেখতাম মেয়েটি সহজ ভঙ্গিমায় সব বাচ্চাদের সাথে খেলছে। আমার মেয়েকে আদর করত, দুজনে ছবিও তুলেছে একসাথে। অনুকরণীয় পারিবারিক আবহে, বিশেষ করে বাবার বন্ধুবৎসল ভালোবাসায় বড় হয়ে ওঠা মেয়েটির জীবনযাপন বাংলাদেশের আর দশটা মেয়ের মতই আটপৌরে। বিলেতের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে এখন সে একজন প্র্যাকটিসিং ব্যারিস্টার।
মেয়েটির নাম জাইমা রহমান, শহীদ জিয়াউর রহমান ও বেগম খালেদা জিয়ার দৌহিত্রী। তার পিতা নিপীড়িত মানুষের আশ্রয়স্থল মজলুম জননেতা তারেক রহমান, মা ডাক্তার জুবাইদা রহমান। মেয়েটির নানা মাহবুব আলী খান ছিলেন বাংলাদেশ নৌবাহিনীর প্রধান, নানী বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক ইকবাল মান্দ বানু। জিয়া পরিবারের তৃতীয় প্রজন্ম জাইমা রহমান, মেধা ও মননে অতুলনীয় একজন মানুষ।
জেনেটিক ইন্জিনিয়ারিংয়ের বিস্ময়কর অগ্রগতি বলে দিচ্ছে, একদিন শুয়োর ও মানুষের জিনের মিশ্রণে তৈরি হবে শুয়োরমানব। তারা আমাদের সমাজে বসবাস করবে, কিন্তু তাদের আচরণ, চলাফেরা ও কথাবার্তা হবে শুয়োরের মত। তবে সৃষ্টির যিনি মহান কারিগর, তিনি আমাদের শিক্ষার উদ্দেশ্যে, আমাদের উপলব্ধির জন্য এবং আমাদের সংশোধনের প্রয়োজনে স্যাম্পল হিসেবে আগে থেকেই বানিয়ে রেখেছেন কিছু শুয়োরমানব। আমার খুব নিকট থেকে দেখা, মার্জিত-রুচিশীল-সুশিক্ষিত, নরম মনের একটি মেয়ে, একজন খাঁটি দেশপ্রেমিক জাইমা রহমানকে নিয়ে শ্রবণঅযোগ্য কথা বলেছে এমনই একটি শুয়োরমানব।
কষ্ট হয়, ক্ষমতা বাঁচিয়ে রাখতে বাংলাদেশের রাজনীতিকে নষ্টামোর সর্বোচ্চ সীমায় নিয়ে গেছে বর্তমান শাসকগোষ্ঠী। লাজলজ্জা-বিবেক-বিবেচনা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক লাম্পট্যের জন্ম দিয়েছে আওয়ামী লীগ। মন্ত্রীসভায় শুয়োরমানবদের অন্তর্ভুক্তিই প্রমাণ করে, এই দল ও তার প্রধান কখনো আর সম্প্রীতি-সহাবস্থানের রাজনীতি করবে না। যারা শেখ হাসিনার রাজত্বের পক্ষে লম্বা লম্বা বুলি মারেন, আমাদেরকে অহর্নিশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা শেখান, তারা কী বলবেন? নির্লজ্জতা, হিংস্রতা, বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার নৌকায় চড়ে বাংলাদেশে কুরুচিপূর্ণ রাজনীতির যে বিভাজন তৈরি করেছে আওয়ামী লীগ, তার পরিণতি কোথায়?
জাইমা রহমান রাজনীতিতে আসবে কিনা, আসলে কখন আসবে—তা সময়ই বলে দিবে। কারো নসিহতের দরকার নেই। শুয়োরমানবরা যতই ‘বাবার দেশ’ ‘বাবার দেশ’ বলে চিল্লাক, জনগণ তাদের সেই তথাকথিত সম্পাদ্য প্রত্যাখ্যান করে। দেশটা আমাদের। আজ হোক কাল হোক, আমরা আমাদের দেশ বুঝে নেবই। আমরা জানি, দেশ, জাতি ও মানুষের দুর্দিনে জিয়া পরিবার বসে থাকে না।
ব্যারিস্টার আবু সায়েম
লন্ডন, ৪ ডিসেম্বর ২০২১
[পুনশ্চ- সারাদিন লেগেছে লেখাটি লিখতে। আল্লাহ সাক্ষী, বুকে অসম্ভব চাপ অনুভব করছিলাম। শরীর-মনে অসুস্থ বোধ হচ্ছিলো। প্রতি মুহূর্তে শুয়োরমানবটার কদর্য কথাগুলো কানে বাজছিলো, চোখের সামনে ভেসে উঠছিলো তার কুৎসিত-বিভৎস চেহারা। যদি শয়তানটার দু’গালে কষে জুতাপেটা করতে পারতাম, তাহলে হয়তো আমার রাগ কিছুটা কমতো।]

Abu Sayem
Barrister & Writer UK

আরো পড়ুন