প্রয়াত শহীদ ডা. মঈনুদ্দীন স্যারের স্ত্রীর আবেগঘন বক্তব্য:

প্রয়াত শহীদ ডা. মঈনুদ্দীন স্যারের স্ত্রীর আবেগঘন বক্তব্য:

১) আমি তিনটা বছর একা কষ্ট করেছি, কী পরিমাণ কষ্ট সেটা কাউকে বলতে ইচ্ছে করছে না। সেই তিন বছর আমার হাসবেন্ড উচ্চতর ডিগ্রী নিতে সিলেট ওসমানি মেডিকেল কলেজে ছিলেন। সরকারী কোনো টাকা পেতেন না।

আমি চাকরি করে ঢাকা শহরে বাসা ভাড়া, খাওয়া খরচ একা চালিয়েছি। ভয়ে কম খেতাম, কোনো আত্মীয় স্বজনের দাওয়াতে, বিয়েতে খরচের ভয়ে যেতাম না। কম খাওয়ার দরুণ আমার গর্ভের সন্তান পুষ্টি পায়নি, গ্রোথ রেস্ট্রিকশন ধরা পড়েছিল।

আমি একজন ডাক্তারের স্ত্রী। ঢাকা মেডিকেল থেকে পাশ করা ডাক্তার।

২) অনারারি করা ডাক্তারেরা এক পয়সাও পেতেন না। তাদের “অনাহারী” বলে উপহাস করা হয়। অথচ তাদের সংসার আছে। আমার পরিচিত এক ডাক্তার ভাই সুদে টাকা ধার নিতে বাধ্য হন পরিবার চালাতে। একজন ডাক্তারের কথা শুনেছিলাম যে তিনি তার বাচ্চার জন্য দুধ কিনে দিতে পারতেন না।

সবাই ভাবে ডাক্তারদের অনেক অনেক টাকা। টাকার বস্তা নিয়ে তারা ঘুরে বেড়ায়।

এমবিবিএস পাস করার পর হাসপাতালে ডিউটি ডাক্তারদের বেতন কত জানেন? কোনো মেডিকেল কলেজ দেয় পনেরো হাজার, কেউ আঠারো হাজার। গুলশানের একটা নামকরা মেডিকেল কলেজ একজন এমবিবিএস পাশ করা লেকচারারকে বারো হাজার টাকা বেতন দিত। এখন কত দেয়, জানি না।

এই সামান্য টাকায় তারা কীভাবে সংসার চালাবে?

সরকারী ডাক্তারদের বেতন একই স্কেলের ক্যাডারদের বেতনের সমান। বর্তমানে একজন এন্ট্রি লেভেলের ৯ম গ্রেডের সরকারী মেডিকেল অফিসারের বেসিক বেতন ২২ হাজার টাকা। অথচ তারা কি পরিমাণ ডিউটি করেন, জানেন?

আমার দুই বোন সরকারী ডাক্তার। ওদের সন্তানেরা কতটুকু বঞ্চিত হয়েছে তা আমি দেখেছি। দিনের পর দিন বাচ্চাদের ডিপরাইভ করেছে। দিন শেষে কী পেয়েছে? আমজনতার গালি, কসাই উপাধি।

আমার আরেক বোন সরকারী কলেজে আছে, তাদের সরকারী শিক্ষা ছুটি দেখলে চোখ কপালে উঠবে। রমজানের প্রায় পুরো মাস ছুটি। আর আমার ডাক্তার বোন ঈদের পরের দিনও ডিউটি করেছে। হাসপাতালে হিন্দু ডাক্তার না থাকায় ঈদের দিনের এক শিফটে তাকে ডিউটি করতে দেখেছি।

যখন আপনারা চাকরিতে ঢুকে আরাম করেছেন, বউ-বাচ্চাকে সময় দিয়েছেন, হানিমুন করেছেন, তখন তারা চাকরি করে পেটের ক্ষুধা মিটিয়েছেন আবার রাত জেগে পড়েছেন একটা ডিগ্রির জন্য যাতে তাদের পরবর্তী জীবন সহজ হয়। কত রাত, কত দিন গেছে, কল্পনাও করতে পারবেন না। সব আনন্দ, সব কিছু তুচ্ছ করে তারা কাজ করেছেন, দিন শেষে রাত জেগে পড়াশুনা করেছেন।

আমি আমার বিয়ের প্রথম জীবনে আমার ডাক্তার স্বামীর কাছে সময়, টাকা তেমন কিছুই পাইনি। যখন অন্যরা আনন্দ করতে ব্যস্ত, তখন আমরা বেঁচে থাকার লড়াইয়ে ব্যস্ত ছিলাম।

অথচ আমজনতা ভাবে ডাক্তারেরা টাকা নিয়ে বসে আছে। গ্রাম থেকে আমার বাসায় আসা অর্ধশিক্ষিত রোগীও প্রফেসরকে দেখাতে চান যার হাজার টাকা ভিজিট। তাদের সামান্য অসুখে কম ভিজিটের জুনিয়র ডাক্তারকে দেখালেও পারত। অথচ তারা নামকরা প্রফেসর ডাক্তার দেখাতে চান। এই নামকরা প্রফেসরের বয়স কত? তার জীবনের সংগ্রামের গল্পটা কেউ জানেন? দিন শেষে ডাক্তারকে তারা গালি দিয়ে গেছে, তিন মিনিটে হাজার টাকা? বাপরে বাপ!

বিদেশী ডাক্তারের মুখ দিয়ে মধু বের হয়, কথা সত্য। দেশি ডাক্তারেরা, বিশেষ করে সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারেরা সময় দেন না, মুখ দিয়ে মধু বের হয় না। দিনে কত রোগী আসে জানেন? কত রোগীর বিপরীতে কত জন ডাক্তার থাকার কথা আর কতজন আছেন, হিসেব বলতে পারবেন?

গত বছর আমার ছোট মেয়ে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে খারাপ অবস্থায় চলে গিয়েছিল। উত্তরার একটা নরম্যাল হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছিলাম, তারা যখন আশা ছেড়ে দিল, আমরা একটা আইসিইউ এর জন্যে রাতের বেলা হন্যে হয়ে ঘুরি। তখন সব হাসপাতাল রোগীতে ভর্তি, কোথাও ফাঁকা নাই। শেষমেশ একজন ডাক্তার ভাইয়ের রেফারেন্সে এপোলো হসপিটালে ভর্তি করাতে পারি। এই হাসপাতাল বিদেশি ডাক্তারে ভরপুর। নিট এন্ড ক্লিন, একটু পর পর বাচ্চার পছন্দ অনুযায়ী পুষ্টিকর খাবার সাপ্লাই দিয়ে যায়। নার্স, আয়া, ক্লিনার, পুষ্টিবিদ, ডাক্তার সবাই হাসিমুখে কথা বলে। কী তাদের ব্যবহার! মধু মধু!

এই হাসপাতালে একদিনের আইসিইউ এর বিল জানেন?
আমরা ধারে বিল শোধ করেছিলাম, কত মাস লেগেছে সেই ঋণ শোধ করতে সে গল্প আর বললাম না। টাকা খরচ করলে মধু ব্যবহার পাওয়া যায়, সেটা দেশে হোক বা বিদেশে।

ডাক্তারদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। তারা জীবন বাজি রেখে করোনা আক্রান্ত রোগীদের সেবা দিয়ে যাচ্ছে। তার বিনিময়ে তারা কয় টাকা বেতন পাবে?

সরকারী চাকরিজীবী ডাক্তারদের বেতন সবাই জানে। বেসরকারী হাসপাতালের একজন ডিউটি ডাক্তারের বেতন অনেক সময় একজন গার্মেন্টস কর্মীর বেতনের সমান হয়। রোগীর টাকা অধিকাংশটাই মালিক পায়। ডাক্তার নয়। তিনি তো সামান্য কর্মজীবী।

সরকারী মেডিকেলের অব্যবস্থাপনা, হুইল চেয়ার নাই, বেড নাই, ইকুপমেন্ট নাই, এর দায় কার? ডাক্তার তো সামান্য চাকরিজীবী। তাদের এসব ব্যবস্থাপনার ক্ষমতা নাই। আপনি আসল জায়গায় নাড়া দেন। প্লিজ ডাক্তারদের পেছনে লাগিয়েন না।

তারা ট্যাক্সের টাকায় ডাক্তার হয়েছে? আপনি ট্যাক্সের টাকায় পড়েননি? সব বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ ট্যাক্সের টাকায় চলছে। তাহলে কেন শুধু ডাক্তারদের দিকে আঙ্গুল উঠান?

যারা ত্রাণের চাউল মেরে খাচ্ছে, বিদেশে আনন্দ ভ্রমণ করেছে, ট্রেনের স্লিপারে বাঁশ লাগিয়ে মানুষ মেরেছে, দুর্নীতিবাজ সরকারি ইঞ্জিনিয়ার, বালিশ কেলেংকারি, পর্দা কেলেংকারির নায়কেরা, ব্যাংক ডাকাতরা এদের ধরেন। যারা অসৎ ডাক্তার তাদেরকেও ধরেন, কিন্তু গণহারে ডাক্তারদের গালি দিয়েন না প্লিজ। তাদের উৎসাহ দিন, কাজ করতে দিন।

Dr. Mst. Umme Bushra Sumona
( ড. উম্মে বুশরা সুমনা)

You might also like