বেফাঁস কথায় ফাঁসলেন — রাঙ্গা

‘নূর হোসেন কে? একটা অ্যাডিকটেড ছেলে, একটা ইয়াবাখোর, ফেনসিডিলখোর’—নব্বইয়ে এরশাদবিরোধী আন্দোলনে নিহত শহিদ নূর হোসেনকে নিয়ে এমন মন্তব্য করে সাম্প্রতিক সময়ে প্রথম সমালোচিত হন জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব থেকে দুই দিন আগে ছিটকে পড়া মসিউর রহমান রাঙ্গা। মহাসচিব হওয়ার পর থেকে গত এক বছর আট মাসে নূর হোসেন ছাড়াও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সরকারের মন্ত্রিসভা নিয়ে একাধিকবার বিরূপ মন্তব্য করেন তিনি। জাপার শীর্ষ নেতৃত্ব বলছেন, এসব বিতর্কিত নানা মন্তব্য ছাড়াও দলের ভেতরে ঘটানো কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য মহাসচিব পদ হারিয়েছেন রাঙ্গা।

শহিদ নূর হোসেন দিবসে গত বছরের ১০ নভেম্বর (যদিও জাপা দিনটিকে পালন করে ‘গণতন্ত্র দিবস’ হিসেবে) ঢাকা মহানগর উত্তর জাপার উদ্যোগে দলের বনানী কার্যালয়ে আয়োজিত আলোচনা সভায় রাঙ্গা বলেছিলেন, ‘নূর হোসেনকে নিয়ে গণতান্ত্রিক দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নাচানাচি করে।’ একই অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রীরও সমালোচনা করেন রাঙ্গা।

বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী ও নূর হোসেনকে নিয়ে কটূক্তির কারণে গত বছরের ১২ নভেম্বর সংসদে অনির্ধারিত আলোচনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। তারা রাঙ্গাকে ক্ষমা চাইতে বলেন। এমনকি জাপার কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদও কড়া সমালোচনা করেন রাঙ্গার। আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য তোফায়েল আহমেদ সেদিন বলেছিলেন, ‘রাঙ্গা কুিসত বক্তব্য দিয়েছেন। তিনি বঙ্গবন্ধু ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিয়েও খারাপ মন্তব্য করেছেন। সংসদে দাঁড়িয়ে তার ক্ষমা চাওয়া উচিত।’

তোপে পড়ে পরদিন নিজের বক্তব্যের জন্য সংসদে দাঁড়িয়ে ক্ষমা চান রাঙ্গা। সংসদে কার্যপ্রণালি বিধির ২৭৪ ধারা অনুযায়ী ব্যক্তিগত কৈফিয়তে রাঙ্গা সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি একটা ভুল করেছি। এজন্য আমি নূর হোসেনের পরিবারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছি। সংসদে দাঁড়িয়ে আমি অজস্রবার জয়বাংলা বলেছি, জাতির পিতা বলেছি। জাতির পিতাকে নিয়ে কোনো রকম ভুল বলে থাকলে এর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী।’ রাঙ্গা সেদিন সংসদে আরো বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রীকে সন্ত্রাসবাদ-দুর্নীতিবাজ এগুলো বলিনি।’ নূর হোসেনের মা ও ভাইও সেসময় রাঙ্গার বিচার দাবি করেছিলেন।

সর্বশেষ গত ১৭ জুলাই নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ উপজেলার কাঞ্চন পৌরসভার কেন্দুয়া এলাকায় উপজেলা জাপা কার্যালয়ে এরশাদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে রাঙ্গা বলেছেন, ‘বর্তমান সরকারের মন্ত্রিসভার সব সদস্য অথর্ব। তারা লুটপাটে ব্যস্ত। স্বাস্থ্য খাতকে দুর্নীতির মাধ্যমে ভঙ্গুর করে দিয়েছেন বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী। পাটকল বন্ধের মাধ্যমে পাটমন্ত্রী গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন।’

বর্তমান একাদশ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনে জাপা থেকে নির্বাচিতদের কারো কারো সঙ্গে গোপন চুক্তি করেছিল জাপা। কিন্তু সংসদ সদস্য হয়ে যাওয়ার পর কেউ কেউ সেই ‘অঙ্গীকার’ বাস্তবায়ন করেননি। এই অঙ্গীকার ছিল মূলত টাকার। চুক্তি অনুযায়ী টাকা না দেওয়ায় গত বছরের ২০ মে সংরক্ষিত আসনে দলের মহিলা এমপি অধ্যাপিকা মাসুদা এম রশীদ চৌধুরীকে নোটিশ পাঠিয়েছিলেন জাপার তখনকার মহাসচিব রাঙ্গা। এ নিয়ে তখন মুখ খুলেছিলেন জাপার আরো একাধিক নারী এমপি। নারী এমপিদের কাছ থেকে নেওয়া টাকা দলের তহবিলে সঠিকভাবে জমা না হওয়ার বিষয় নিয়েও জাপার ভেতরে নানা কথা হয়।

এ বছরের ২ জুন রাতে রংপুরে পল্লীনিবাসে ডিও লেটারে স্বাক্ষর না করায় রংপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ও এরশাদপুত্র রাহগীর আল মাহী সাদ এরশাদ ও তার স্ত্রীর ওপর হামলার ঘটনায় স্থানীয় জাপা নেতা টিপু সুলতানকে আটক করে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। পরে গণমাধ্যমে বিবৃতি পাঠিয়ে টিপুর পক্ষ নেন রাঙ্গা।

রবিবার দলের মহাসচিব পদ থেকে বাদ পড়ার পর মসিউর রহমান রাঙ্গা ইত্তেফাককে বলেছেন, কেন তাকে বাদ দেওয়া হয়েছে—সে বিষয়ে তিনি কিছুই জানেন না। তাকে কিছু জানানোও হয়নি। এমনকি কারণ জানতে দলের চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে ফোন করলেও তিনি ধরেননি বলে জানান রাঙ্গা।

জাপার দায়িত্বশীল একাধিক নেতা ইত্তেফাকের সঙ্গে আলাপকালে জানান, এরশাদের ভাতিজা আসিফ শাহরিয়ারকে কয়েক দিন আগে দলে ফিরিয়ে নেওয়ায় জি এম কাদেরের সঙ্গে অশোভন আচরণ করেছেন রাঙ্গা। আর রংপুরে সাদ দম্পতির ওপর হামলার ঘটনায় অভিযুক্তের পক্ষ নিয়ে রওশনেরও বিরাগভাজন হন তিনি। সব মিলিয়ে দলের কোনো পক্ষেরই এখন আর রাঙ্গার প্রতি সহানুভূতি নেই। যদিও রাঙ্গা ইত্তেফাককে বলেছেন, রবিবার মহাসচিব পদ হারানোর পর তিনি রওশন এরশাদকে ফোন করেছেন, তিনি তাকে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়ে বলেছেন—সময়মতো সব ঠিক হয়ে যাবে।

তবে জাপার নবনিযুক্ত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু গতকাল মঙ্গলবার ইত্তেফাককে বলেন, ‘রওশন এরশাদসহ সবার সম্মতিতেই আমাকে মহাসচিব করা হয়েছে। রওশন এরশাদ আমাকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছেন।’

এদিকে, খেলাফত আন্দোলন ও কওমি শিক্ষা বোর্ডের নেতাদের সঙ্গে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের, সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুসহ দলটির নেতারা যখন গতকাল বনানী কার্যালয়ে বৈঠক করছিলেন তখন বাইরে বিপুল সংখ্যক পুলিশি নিরাপত্তা ছিল। জানা গেছে, মহাসচিব পরিবর্তনকে কেন্দ্র করে সংঘাতের আশঙ্কা থেকেই পুলিশের কাছে এই নিরাপত্তা চেয়েছিলেন জাপা নেতৃত্ব। সর্বশেষ জানা গেছে, মহাসচিব থেকে সরানোর পর শিগিগরই রাঙ্গাকে সংসদের বিরোধীদলীয় চিফ হুইপের পদ থেকেও বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে।

ইত্তেফাক/ইউবি

আরো পড়ুন