যুক্তরাষ্ট্র বলছে, জিয়া-আকরাম বাংলাদেশে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন বিদেশে
২০২০ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত পুলিশ মেজর জিয়ার গতিবিধি ও অবস্থান জানতো। করোনা মহামারি শুরুর পর পুলিশ তাকে হারিয়ে ফেলে। সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, কয়েক বছর আগে মেজর জিয়া ভারতে ছিলো পরে আমরা শুনতে পাই তিনি দেশে ফিরেছে। মানবজমিন, দ্য ডেইলি স্টার
বিজ্ঞানমনস্ক লেখক ও ব্লগার অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডে জড়িত দণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়া ও আকরাম হোসেনের তথ্য চেয়ে পুরস্কার ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস কর্মসূচির তরফে স্পষ্ট করেই বলা হয়েছে, তাদের ধারণা জিয়া-আকরাম বাংলাদেশেই আছেন। অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, এই দুই আসামি অন্য কোনো দেশে পালিয়ে আছেন। তাদের ধরতে চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আসামিদের অবস্থান নিয়ে দুই ধরনের তথ্য আসায় বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে আসলে এই দুই আসামির অবস্থান কোথায়?
সোমবার অনেকটা আচমকা যুক্তরাষ্ট্রের রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস কর্মসূচি পলাতক এই আসামিদের অবস্থানের বিষয়ে তথ্য দিতে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করে। কূটনৈতিক সূত্র বলছে, এ ধরনের আসামির তথ্য পেতে যুক্তরাষ্ট্র সাধারণত সংশ্লিষ্ট দেশের সহযোগিতা নিয়ে থাকে। ওই দেশের কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে পুরস্কার ঘোষণা দেয়া হয়।
কিন্তু অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের এই আসামিদের বিষয়ে সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের তরফে পুরস্কার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, এভাবে পুরস্কার ঘোষণার মানে হলো, এখানে দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি রয়েছে। এ জন্য সংশ্লিষ্ট দেশের সহায়তা না নিয়ে সরাসরি পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে। যদিও বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তরফে বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের পুরস্কার ঘোষণার বিষয়টি তারা স্বাভাবিকভাবেই দেখছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন ওই পুরস্কারের বিষয়ে বলেছেন, এটি অপরাধীদের ধরতে সহায়ক হবে।
ইন্টারপোলের সদস্য হিসেবে বিদেশে পালিয়ে থাকা অপরাধীদের ধরতে বাংলাদেশ সংস্থাটির সহযোগিতা নিয়ে থাকে। মোস্ট ওয়ান্টেড আসামিদের বিষয়ে ইন্টারপোলে পুলিশের তরফে আবেদন করা হলে ইন্টারপোল থেকে রেড নোটিশ জারি হয়। অভিজিৎ হত্যা মামলার পলাতক এই দুই আসামির বিষয়ে ইন্টারপোলের এমন কোনো নোটিশ নেই। তাদের ধরার ক্ষেত্রে ইন্টারপোলের সহায়তা চাওয়া হয়েছে এমন কোনো তথ্যও জানাতে পারেননি সদর দপ্তরের কর্মকর্তারা।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, যুক্তরাষ্ট্র কেন পুরস্কার ঘোষণা করেছে সে বিষয়ে আমাদের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো চিঠি দেয়নি তারা। যেহেতু অন্য একটি দেশের বিষয় তাই আমাদের দেশে এটা আইনগতভাবে কতোটুকু বিচারযোগ্য সেটা সংশ্লিষ্ট আইন মন্ত্রণালয় এবং বিচার বিভাগ ভালো বলতে পারবেন।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মো. মাহবুব আলম বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক দুই আসামি সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত মেজর সৈয়দ জিয়া ও আকরাম হোসেনকে ধরতে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। আমাদের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তাদের শনাক্তে কাজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ সদর দপ্তরের ডিআইজি (অপারেশন) হায়দার আলী খান বলেন, দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের ধরতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। যুক্তরাষ্ট্র কোন প্রেক্ষাপটে পুরস্কারের ঘোষণা দিয়েছেন এ বিষয়ে আমাদের জানা নেই। তাছাড়া এ বিষয়ে আমরা আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি পাইনি।
যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, দুই আসামি বাংলাদেশেই আছে: ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়ের হত্যাকারীরা বাংলাদেশেই রয়েছে বলে বিশ্বাস করে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্র দপ্তরের রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিস কর্মসূচির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক আপডেটে জানানো হয়েছে যে, অভিজিৎ রায়ের হত্যাকাণ্ডের পেছনে দায়ীরা বাংলাদেশেই রয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
‘মেজর জিয়া’ নামে পরিচিত সৈয়দ জিয়াউল হক এবং আকরাম হোসেন এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত বলে সন্দেহ করা হয়। এর আগে নিজেদের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকাশিত এক টুইটে রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিস জানায়, ২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় একটি বইমেলা থেকে বেরিয়ে আসার সময় আল-কায়েদাভিত্তিক সন্ত্রাসীরা মার্কিন নাগরিক অভিজিৎ রায়কে হত্যা করে এবং তার স্ত্রী রাফিদা বন্যা আহমেদকে আহত করে। ওয়েবসাইটে প্রকাশিত আপডেটে বলা হয়েছে, অভিজিৎ রায় একজন লেখক, ব্লগার ও অধিকারকর্মী যিনি বাংলাদেশে ধর্মীয় মৌলবাদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিলেন। তিনি মানুষের মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় ছিলেন। তাকে তার বিশ্বাস এবং অধিকার আন্দোলনের কারণে টার্গেট এবং হত্যা করা হয় বলেও জানায় রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিস।
এতে আরও বলা হয়, এই হামলার দায় স্বীকার করেছে আনসারুল্লাহ বাংলাটিম বা এবিটি। এটি একটি বাংলাদেশি সন্ত্রাসী সংগঠন। এই সংগঠন তরুণদের ‘ইসলামবিরোধীদের’ হত্যায় প্ররোচিত করে। ওই হত্যাকাণ্ডের পর ‘আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেট’ বা একিউআইএস-এর নেতা আসিম উমার এক ভিডিও বার্তায় দাবি করেন, তাদের অনুসারীরাই অভিজিৎ রায় ও বন্যা আহমেদের ওপরে হামলার জন্য দায়ী।
২০১৬ সালের ১লা জুলাই একিউআইএস-কে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্র। এরপর থেকে জেনেশুনে এই সংগঠনের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখা, একে সমর্থন দেয়া কিংবা এর সঙ্গে মিলে কোনো ষড়যন্ত্রের চেষ্টা করা মার্কিন আইন অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত বলে রিওয়ার্ড ফর জাস্টিস-এর আপডেটে উল্লেখ করা হয়।
জিয়া-আকরাম অন্য কোনো দেশে পালিয়ে-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: ওদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছেন, অভিজিৎ রায় হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী পলাতক মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন বাংলাদেশে নেই। তারা অন্য কোনো দেশে পালিয়ে থাকতে পারে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে খুঁজছে। যত দ্রুত সম্ভব মূল আসামিদের গ্রেপ্তার করে তাদের সাজা প্রদান করা হবে। মঙ্গলবার মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলা পরিষদের সামনে মুক্তিযোদ্ধার ভাস্কর্য উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী এসব কথা বলেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, লেখক অভিজিৎ হত্যা মামলার রায়ে ৫ জনের মৃত্যুদণ্ড ও একজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছে। মেজর জিয়া চতুর লোক। আমাদের কাছে যতটুকু তথ্য আছে, মেজর জিয়া এবং আকরাম হোসেন অন্য দেশে গাঢাকা দিয়ে আছে। আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে যত দ্রুত সম্ভব তাদের ধরে এনে রায় কার্যকর করা হবে। তিনি আরও বলেন, অভিজিৎ হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত হয়েছে। তদন্তে যারা জড়িত ছিল তারা আনসারুল্লাহ বাংলাটিমের সদস্য ছিল। এ ছাড়া ওই সময়ে দেশে জঙ্গি উত্থান হয়েছিল। আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের নিরলস চেষ্টায় তাদের সকল কার্যক্রম ব্যর্থ হয়েছিল।
উল্লেখ্য, ২০১৫ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি বইমেলা থেকে ফেরার পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় হামলার শিকার হন অভিজিৎ রায়। চাপাতির আঘাতে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। হামলায় অভিজিতের স্ত্রী রাফিদা আহমেদও গুরুতর আহত হন। গত ফেব্রুয়ারিতে আলোচিত এ হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার একটি আদালত। রায়ে জঙ্গিগোষ্ঠী আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান ও বরখাস্ত হওয়া মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক, জঙ্গিনেতা আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনানসহ পাঁচজনকে মৃত্যুদণ্ড এবং একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়। জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন মামলা প্রক্রিয়ার শুরু থেকে পলাতক।
সেনাবাহিনী থেকে বরখাস্ত হওয়া জিয়া পালিয়ে জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামে যুক্ত হন বলে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়। ২০১৬ সালে গুলশান হামলার পর জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল সরকার। তখন পুরস্কার ঘোষিত তামিম চৌধুরীসহ জঙ্গিদের কয়েকজন শীর্ষনেতা র্যাব-পুলিশের অভিযানে নিহত হলেও জিয়ার খোঁজ মেলেনি।