দ্বিতীয় স্থানেও নেই আওয়ামী লীগ

খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার রঘুনাথপুর ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মনোজিৎ বালা ৬ হাজার ৬০৩ ভোট পেয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী একই দলের আরেক বিদ্রোহী এএম আমিনুর রহমান। তিনি পেয়েছেন ৪ হাজার ৬২২ ভোট। এ দুই বিদ্রোহী প্রার্থীর দাপটে কোণঠাসা আওয়ামী লীগের প্রার্থী খান সাকুর উদ্দীন ভোট পেয়েছেন মাত্র ১ হাজার ৫৯১।

২১ হাজার ৬১৪ ভোটারের এই ইউপি নির্বাচনে ভোট পড়েছে ১৭ হাজার ৫১১টি। অর্থাৎ ৮১ দশমিক ০২ শতাংশ। এ হিসাবে আওয়ামী লীগের প্রার্থী তার জামানতের টাকাও রক্ষা করতে পারেননি। বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় ধাপে এ ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়।

একই ধরনের ফল দেখা যায় পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলার বুড়াবুড়ি ইউপি নির্বাচনে। এখানে ৩ হাজার ৩১৫ ভোট পেয়ে দ্বিতীয়বারের মতো চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. তারেক হোসেন।

তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের আরেক বিদ্রোহী কামারুজ্জামান কামু ভোট পেয়েছেন ২ হাজার ৮৬৬টি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. শেখ কামাল এতই কম ভোট পেয়েছেন যে, তিনিও প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আসতে পারেননি। এমনকি জামানতও রক্ষা করার মতো ভোটও পাননি।

শুধু জামিরা বা বুড়াবুড়ি নয়, এমন ১৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে প্রতিযোগিতায় আসতে পারেননি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এসব প্রার্থী এতই কম ভোট পেয়েছেন যে তারা দ্বিতীয় অবস্থানও অর্জন করতে পারেননি।

এ ১৩৮টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে দুটিতে জাতীয় পার্টি ও বাকি ১৩৬টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ভোট পাওয়ার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বেশিরভাগই শাসক দলের মনোনয়ন না পেয়ে বিদ্রোহী হিসাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

তবে ২০২টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় ধাপের ৮৩৩টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

আরও দেখা গেছে, গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার নির্বাচন হওয়া ১৪টি ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে সাতটি দলীয় মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং বাকি সাতটি উন্মুক্ত রাখা হয়।

যে সাতটি ইউনিয়ন পরিষদে দলীয় প্রার্থী দেওয়া হয়েছে সেগুলোর মধ্যে দুটিতে তারা ভোট পাওয়ার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানে নেই। বাকি পাঁচটির মধ্যে দুটিতে জয়ী ও তিনটিতে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। উন্মুক্ত করে দেওয়া সাতটি ইউপির হিসাব বাদেই এ তথ্য পাওয়া গেছে।

এ ধাপের ফল ঘোষিত ৮৩৩টির মধ্যে ৩৪৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে হেরে গেছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ৭৭ জনসহ ৪৮৫টিতে জয় পেয়েছেন।

দ্বিতীয় ধাপে স্বতন্ত্ররা ৩৩০, জাতীয় পার্টি ১০, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ ৪ ও অন্য চারটি রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরা একটি করে ইউনিয়নে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

ভোট পড়ার হার ৭৩ দশমিক ৪৯ শতাংশ। বিএনপি দলীয় প্রতীকে এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি। তবে দলটির স্থানীয় অনেক নেতাই এ নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং জয়লাভও করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

মাঠপর্যায়ের দলটির কয়েক নেতার অভিযোগ, যোগ্য ও জনপ্রিয় প্রার্থীকে মনোনয়ন না দেওয়া এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের দাপটের কারণে সরকারদলীয় প্রার্থীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন।

এ কারণে তারা জয়ী প্রার্থীর নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বিতায়ও আসতে পারেননি। যদিও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা তা মানতে নারাজ। তাদের মতে, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে স্থানীয় বিভিন্ন বিষয় ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে। এ কারণে অনেক সময় দলীয় প্রার্থীরা হেরে যান।

এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুর রহমান শনিবার রাতে যুগান্তরকে বলেন, মনোনয়ন বোর্ডের বিবেচনায় সঠিক ব্যক্তিকেই দলীয় প্রতীক দেওয়া হয়েছে। মনোনয়ন পাওয়া সব প্রার্থীই জিতবেন, এমন নয়।

তিনি বলেন, রাজনৈতিক ও দলগত বিষয়ের বাইরেও স্থানীয় অনেক বিষয় নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের ফ্যাক্টর হিসাবে কাজ করে। নানা মেরুকরণের কারণে দলীয় কিছু প্রার্থীর পরাজয় হতে পারে।

অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, নির্বাচনে মানুষের অংশগ্রহণ ছিল আশাব্যঞ্জক। আমাদের প্রার্থীরা রাজনৈতিকভাবে পরাজিত হয়নি। যারা এ নির্বাচনে অংশ নেয়নি, তারাই পরাজিত হয়েছে।

ফল বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া উপজেলায় দ্বিতীয় ধাপে সাতটি ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচন হয়। এতে দুটিতে আওয়ামী লীগ, তিনটিতে একই দলের বিদ্রোহী এবং দুটিতে বিএনপি প্রার্থীরা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন।

যে দুটিতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন সেগুলো হচ্ছে-তেঁতুলিয়া ও শালবাহন। বাকি পাঁচটিতে হেরে যান। এর মধ্যে তিনটি-দেবনগর, ভজনপুর ও বুড়াবুড়ি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীরা দ্বিতীয় অবস্থানেও আসতে পারেননি।

তবে বাংলাবান্ধা ও তিরনইহাট ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলটির প্রার্থীরা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন। প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল থাকায় এমন ফলাফল এসেছে বলে মনে করেন তেঁতুলিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও উপজেলা চেয়ারম্যান কাজী মাহমুদুর রহমান ডাবলু।

তিনি যুগান্তরকে বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল হওয়ার কারণে এবং সঠিক প্রার্থীকে মনোনয়ন দিতে না পারায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা ভালো করতে পারেনি। আমি পঞ্চগড় জেলা মনোনয়ন বোর্ডের সভায় আমি প্রার্থী বাছাই সঠিক না হওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম।

ফল বিশ্লেষণে আরও দেখা যায়, খুলনা জেলার ফুলতলা উপজেলার জামিরা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৫ হাজার ৬৭৭ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. মনিরুল ইসলাম সরদার।

তিন হাজার ৩২৬ ভোট পেয়ে তার নিকটতম অবস্থানে রয়েছেন জামায়াতের প্রার্থী সাইফুল হাসান। অথচ আওয়ামী লীগের প্রার্থী আবু হেনা মোস্তফা কামাল পেয়েছেন মাত্র এক হাজার ১৭৫ ভোট।

এ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ১৫ হাজার ৯৯০টি ভোটের মধ্যে ১৩ হাজার ৩৫৩টি ভোট পড়ে। ভোট পড়ার হার ৮৩ দশমিক ৫৩ শতাংশ। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জামানত হারিয়েছেন।

দ্বিতীয় ধাপে খুলনা জেলায় ২৫টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়। এ জেলার ৭টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ফলাফলে ভোট পাওয়ার দিক থেকে দ্বিতীয় অবস্থানেও আসতে পারেননি আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা।

১০টিতে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা। আর ১০টিতে জিতেছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। বাকি পাঁচটিতে বিএনপির প্রার্থীরা স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচন করে জয় পেয়েছেন।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে খুলনা জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হারুনুর রশীদ যুগান্তরকে বলেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচনে প্রার্থী বাছাইয়ে অনেক জটিলতা থাকে। এ নির্বাচনে জয়ের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিষয় ছাড়া স্থানীয় বিষয়ও জড়িত থাকে। সেই কারণে কয়েকজন প্রার্থী পরাজিত হতে পারে। আমরা যা যাচাই-বাছাই করে কেন্দ্রে রিপোর্ট পাঠাব।

আরও দেখা যায়, পঞ্চগড়ে তিনটি, ঠাকুরগাঁওয়ের দুটি, দিনাজপুরে এক, নীলফামারীতে চার, লালমনিরহাটে এক, রংপুরে দুটি, কুড়িগ্রামে তিন ও গাইবান্ধায় ৮টি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দ্বিতীয় হতে পারেননি আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা। একইভাবে বগুড়ায় ১০টি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে দুটি, নওগাঁয় চারটি, রাজশাহীতে দুটি, পাবনায় একটি, মেহেরপুরে দুটি, কুষ্টিয়ায় একটি, চুয়াডাঙ্গায় একটি, ঝিনাইদহে একটি, যশোরে চারটি, মাগুরায় একটি, নড়াইলে চারটি, খুলনায় সাতটি ও সাতক্ষীরায় দুটিতে প্রতিযোগিতায় নেই দলটির প্রার্থীরা।

অন্যান্য জেলার মধ্যে পিরোজপুরে একটি, জামালপুরে দুটি, শেরপুরে একটি, ময়মনসিংহে ১২টি, নেত্রকোনায় চারটি, টাঙ্গাইলে তিনটি, কিশোরগঞ্জে সাতটি, মানিকগঞ্জে একটি, মুন্সীগঞ্জে দুটি, গাজীপুরে একটি, নরসিংদীতে দুটি, ঢাকা জেলায় দুটি, রাজবাড়ীতে একটি, ফরিদপুরে একটি, মাদারীপুরে তিনটি, গোপালগঞ্জে দুটি, সুনামগঞ্জে ছয়টি, সিলেটে তিনটি, মৌলভীবাজারে দুটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় তিনটি, কুমিল্লায় একটি, নোয়াখালীতে চারটি, লক্ষ্মীপুরে একটি, কক্সবাজারে চারটি ও রাঙ্গামাটিতে দুটি রয়েছে।

যেসব জায়গায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছেন : পঞ্চগড়ে দুটি, ঠাকুরগাঁওয়ে তিনটি, দিনাজপুরে দুটি, নীলফামারীতে চারটি, লালমনিরহাটে একটি, রংপুরে পাঁচটি, কুড়িগ্রামে দুটি, গাইবান্ধায় দুটি ও জয়পুরহাটে একটি। এছাড়া বগুড়ায় দুটি, চাঁপাইনবাবগঞ্জে চারটি, নওগাঁয় পাঁচটি, রাজশাহীতে তিনটি, নাটোরে পাঁচটি, সিরাজগঞ্জে একটি, পাবনায়, মেহেরপুরে পাঁচটি, কুষ্টিয়ায় সাতটি, চুয়াডাঙ্গায় একটি, ঝিনাইদহে পাঁচটি ও যশোরে পাঁচটি। বাকি জেলাগুলোর মধ্যে মাগুরায় দুটি, খুলনায় আটটি, সাতক্ষীরায় আটটি, পটুয়াখালীতে ছয়টি, ভোলায় দুটি, পিরোজপুরে তিনটি, জামালপুরে দুটি, শেরপুরে চারটি, ময়মনসিংহে সাতটি, নেত্রকোনায় তিনটি, টাঙ্গাইলে দুটি, কিশোরগঞ্জে দুটি, মানিকগঞ্জে দুটি, মুন্সীগঞ্জে সাতটি ও গাজীপুরে দুটি। নরসিংদীতে চারটি, নারায়ণগঞ্জে ছয়টি, ঢাকা জেলায় পাঁচটি, ফরিদপুরে পাঁচটি, গোপালগঞ্জে তিনটি, মাদারীপুরে পাঁচটি, শরীয়তপুরে চারটি, সুনামগঞ্জে চারটি, সিলেটে ছয়টি, মৌলভীবাজারে দুটি, হবিগঞ্জে একটি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পাঁচটি, কুমিল্লায় চারটি ও নোয়াখালীতে চারটি। আরও আছে চট্টগ্রামে পাঁচটি, কক্সবাজারে ছয়টি, খাগড়াছড়িতে দুটি এবং রাঙ্গামাটিতে তিনটি ইউনিয়ন পরিষদে।

আরো পড়ুন