নিশ্চিত হয়নি ঈদযাত্রা
ঈদ যাত্রা নিয়ে ধোঁয়াশা এখনও কাটেনি। ঈদে গণপরিবহন চলবে কি-না, মানুষ গ্রামের বাড়ি যেতে পারবে কি-না তা এখনও নিশ্চিত হয়নি। ঈদের সময় ৯ দিন গণপরিবহন বন্ধ রাখার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনার পর সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, গণপরিবহন চলবে। তবে পণ্যবাহী যানবাহন বন্ধ থাকবে। এরপর গতকাল শনিবার পর্যন্ত আর কোনো নির্দেশনা কোনো তরফ থেকে আসেনি। তবে গতকাল রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেছেন, ঈদে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে না। এখন যেমন চলছে তেমনই চলবে। বাস মালিক সমিতির নেতারা বলেছেন, ঈদে গণপরিবহন চলাচলের বিষয়ে এখনও তারা কোনো নির্দেশনা পাননি। নতুন কোনো নির্দেশনা না পেলে চলমান সীমিত পরিসরেই চলবে বাস। লঞ্চ মালিকরাও সরকারের নির্দেশনার অপেক্ষায় আছেন।
ঈদে সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীদের কর্মস্থল ত্যাগ না করার নির্দেশনা জারি করেছে সরকার। এতে করে এমনিতেই এবার ঈদ যাত্রায় ঘরমুখো মানুষের সংখ্যা কম হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। তারপরেও গত ঈদুল ফিতরের মতো হাজার হাজার মানুষের ঢল নামলে করোনার সংক্রমণ আরও বেড়ে যাবে বলে বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পাবলিক হেলথ অ্যাডভাইজারি কমিটির সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি প্রফেসর ডা. প্রাণ গোপাল দত্ত বলেন, গত ঈদের পরপরই সংক্রমণ বেড়ে গিয়েছিল। এবারও আশঙ্কা আছে। সেই আশঙ্কা থেকে সরকারকে কমিটির পক্ষ থেকে কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। চলাচল সীমিত করার জন্য কমিটি মানুষের চলাচল সীমিত করার পরামর্শ দিয়েছে। কমিটি বলেছে, শহর থেকে গ্রামের বাড়িতে যাওয়া বন্ধ করার জন্য ঈদের আগের ও পরের তিন দিন চলাচল কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানা ও ভিড় কমানোর ব্যবস্থা করতে হবে। দেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শনাক্ত হয়েছে আজ ৪ মাস ১১ দিন। এ ভাইরাসের উৎপত্তিস্থল চীন থেকে শুরু করে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এলেও বাংলাদেশে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না এখন পর্যন্ত। উল্টো নমুনা পরীক্ষায় কভিড-১৯ পজিটিভ শনাক্তের হার বেড়ে চলেছে দিন দিন। এ অবস্থার মধ্যেও দিব্যি ঘুরে বেড়াচ্ছে মানুষ। অনেকটা আগের অবস্থায় ফিরে আসছে জনসমাগম। স্বাস্থ্যবিধি মানার ক্ষেত্রেও দেখাচ্ছে ঢিলেমি। গুগলের সর্বশেষ কমিউনিটি মবিলিটি রিপোর্টও বলছে, দেশে আগের তুলনায় সবক্ষেত্রেই মানুষের চলাচল বেড়েছে। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভয়ানক ছোঁয়াচে এ ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকার সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে ঘরে থাকা। আর নিতান্তই যদি বাইরে যেতে হয় তাহলে সেক্ষেত্রে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে যথাসম্ভব জনসমাগম এড়িয়ে চলার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। কিন্তু তাদের এ পরামর্শ মানছে না অধিকাংশ মানুষ।
ঈদের পাঁচ দিন আগে থেকে ঈদের তিন দিন পর পর্যন্ত মোট ৯ দিন গণপরিবহন বন্ধ রাখার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে চিঠি দিয়েছিল। করোনাভাইরাস সংক্রমণের বিস্তার রোধে কভিড-১৯ জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সুপারিশের আলোকে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। পরামর্শক কমিটি ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রাম থেকে অন্যান্য স্থানে যাতায়াত বন্ধ রাখার পরামর্শ দিয়েছে। এ বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেয়া হয়। তবে গত বৃহস্পতিবার সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ঈদের সময় গণপরিবহন চালু থাকবে। আগের দিন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীও একই কথা বলেছেন। বিষয়টি এখন এই পর্যায়ে থেমে আছে। সেক্ষেত্রে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের আগের নির্দেশের কি হবে তা কেউ জানে না।
বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি এ প্রসঙ্গে বলেছেন, রবিবারের আগে এ বিষয়ে তিনি স্পষ্ট কিছু বলতে পারবেন না। তবে তিনি বলেন, পোশাকশিল্পে কর্মরত কেউ এবারের ঈদে বাড়ি যেতে পারবে না। এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন বাস মালিক বলেছেন, ঈদের বাকি আর মাত্র ১১দিন। ঈদে দূরপাল্লার বাস চলবে কি না তা এখনও স্পষ্ট নয়। তাদের মতে, সরকারি সিদ্ধান্ত নিয়ে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হলে শেষ পর্যন্ত মালিক ও যাত্রী উভয়ে বিপাকে পড়বে। এখন থেকেই বিষয়টি পরিকল্পিত না হলে শেষ বেলায় এসে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ গতরাতে ইনকিলাবকে বলেন, ঈদে দূরপাল্লার বাস চলবে। এখন যেমন স্বাস্থ্যবিধি মেনে বাস চলছে, ঈদেও তেমনি চলবে। তিনি বলেন, এখন যাত্রীর অভাবে গাড়ির সংখ্যা কমে গেছে। ঈদে যাত্রীর সংখ্যা বাড়লে গাড়ির সংখ্যাও বাড়বে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের নির্দেশনায় চার জেলা থেকে লোক যাতায়াত বন্ধ থাকবে প্রসঙ্গে বাস মালিকদের সবচেয়ে বড় সংগঠনের নেতা খন্দকার এনায়েতউল্যাহ বলেন, ওটা ভুল ছিল। ‘পণ্যপরিবহনের’ স্থলে ভুলে ‘গণপরিবহন’ বন্ধ থাকবে বলা হয়েছিল। এ কারণেই বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল।
এদিকে, সাধারণ ছুটি প্রত্যাহারের পর সীমিত পরিসরে সারা দেশে গণপরিবহন চলছে। রেলওয়ে ১৭ জোড়া ট্রেন পরিচালনা করছে। ট্রেনের সেবা বাড়ানোর বিষয়ে কোনো নির্দেশনা পায়নি রেলওয়ে বিভাগ। এমনকি ঈদের আগে মালবাহী গাড়ি চলাচল বন্ধ থাকে, সে বিষয়েও এখনো কোনো সিদ্ধান্ত আসেনি। তবে রেলমন্ত্রী গতকাল জয়দেবপুরসহ চারটি রেল স্টেশন পরিদর্শনকালে সাংবাদিকদের বলেছেন, ঈদে ট্রেনের সংখ্যা বাড়বে না। যাত্রীর চাপ বেশি হলে কোচের সংখ্যা বাড়বে কিনা সে বিষয়েও এখনও কোনো নির্দেশনা পাননি বলে জানিয়েছেন রেলের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক সরদার সাহাদাত আলী বলেন, এখন পর্যন্ত ঈদের সময় ট্রেন পরিচালনা কী রকম হবে সে সিদ্ধান্ত আসেনি। অন্যান্যবার ঈদের আগে কনটেইনার পরিবহন বন্ধ রাখা হয়। তবে এবার ট্রেন কম। কনটেইনার পরিবহন বন্ধ রাখা হবে কি না সে বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়নি।
করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় সরকারঘোষিত সাধারণ ছুটির সময় গণপরিবহন বন্ধ রাখা হয়। গেল ঈদুল ফিতরে শেষ সময়ে এসে ব্যক্তিগত গাড়িতে ঈদের ছুটিতে লোকজন বাড়ি যেতে পারবে বলে ঘোষণা আসে। এতে ব্যাপক বিশৃঙ্খলার ঘটনাও ঘটে। বিষয়টি মাথায় রেখে সংক্রমণের ঝুঁকি এড়াতেই আসন্ন ঈদুল আযহার সময় চার জেলা থেকে অন্যান্য স্থানে যাতায়াত বন্ধ রাখার পরামর্শ আসে জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির কাছ থেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কমিটির পরামর্শ মানা হবে কি-না তা নিয়ে রীতিমতো সন্দেহ ঘনিভূত হচ্ছে দিন দিন। তবে সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন আজ রোববার সরকারের তরফ থেকে এ বিষয়ে একটি স্পষ্ট ঘোষণা আসতে পারে। তবে করোনার সংক্রমণরোধে ঈদে গণপরিবহন বন্ধ রাখার পক্ষেই বিশেষজ্ঞরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি ও ভাইরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ঈদে ঢাকা থেকে যারা যাবে, তাদের অনেকে করোনাভাইরাস বহন করেই যাবে। এতে অন্যান্য বিভাগে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে। এসব লোকজন যেতে যেতে একজন অন্যজনের মধ্যে ছড়াবে। আবার তারা যে বাসায় যাবে, সেখানে তারা বাড়ির লোকজনদের মাঝে ছড়াবে। এর ফলে যেটা হবে, সারা বাংলাদেশে করোনা ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়বে। ঢাকার বাইরে যে সব এলাকায় করোনা কম ছিল। সেখানে বাড়বে। অর্থাৎ মোট প্রাদুর্ভাব বাড়বে।