পুরো রাষ্ট্রযন্ত্র যখন এক ভয়ানক সিন্ডিকেটের খপ্পরে

করোনা মোকাবেলা করতে গিয়ে এই দেশের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা সবকিছু যেমন লেজে-গোবরে করে ফেলেছে সেটা দেখে আমরা কেউ কি অবাক হয়েছি? সেটা হলে আমরা এই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা সম্পর্কে খুব বেশি খোঁজ খবর রাখি না।
রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যসেবার ওপরে মানুষের অনাস্থা এতটাই যে সেখানে সেবা নিতে মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে সমাজের ওপরের দিকের মানুষরা কখনোই যান না, যান বেসরকারি হাসপাতালে। নিম্ন-মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে হতদরিদ্রদের চিকিৎসার জায়গা রাষ্ট্রীয় হাসপাতালগুলো। কিন্তু সেখানেও তারা পূর্নাঙ্গ চিকিৎসা পান না, অনেককেই ঋণ করে, জমি বিক্রি করে বেসরকারি চিকিৎসা নিতে হয়। যেহেতু আমাদের দেশের ‘সচেতন নাগরিকগণ’ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান না, তাই এই হাসপাতালগুলোর সমালোচনাও আমাদের সামনে খুব বেশি আসে না। তবে করোনা আমাদের সেই ‘কমফোর্ট জোন’ ভেঙে দিয়েছে – আমরা বাধ্য হয়েছি কিংবা বাধ্য হবার আশংকায় থেকেছি রাষ্ট্রীয় হাসপাতালে যেতে। সে কারণেই এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অবস্থা আমাদের এতটা চোখে পড়লো।
যারা কিছুটা খোঁজ-খবর রাখেন, তারা জানতেন – এই দেশের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বছরের পর বছর সীমাহীন লুটপাট, অপর্যাপ্ত বরাদ্দ, অদক্ষতা, অব্যবস্থাপনার শিকার হয়ে যে একেবারে ভঙ্গুর হয়ে পড়েছিল। এই প্রবণতা এই দেশের সকল রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান এবং পরিষেবার। করোনা এসে এই দেশের রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা সম্পর্কে নতুন কিছু কি জানিয়েছে আমাদের? আমি মনে করি না, করোনা এই স্বাস্থ্য ব্যবস্থার বীভৎস পচনটা প্রকাশ্য করেছে, প্রমাণ করেছে মাত্র।
স্বাস্থ্য খাতে আমাদের সামনে যা যা উন্মোচিত হলো তার মধ্যে আছেন রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক মো. সাহেদ। এই ব্যক্তি শুধু স্বাস্থ্যখাত নয় আমাদের সামনে প্রকাশ করে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটা নিয়ে কথা বলার আগে তার সম্পর্কে জানা খুব গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা তথ্য আবার একটু জেনে রাখা যাক –

• চেক জালিয়াতির মামলায় ১০ বছর আগে ২০১০ সালে তার ছয় মাসের কারাদণ্ড হয়েছিল। পলাতক থাকায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল, কিন্তু সে ১০ বছর কোনরকম সমস্যা ছাড়া দেশের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মানুষের সাথে ওঠাবসা করেছে। তাকে গ্রেফতারের জন্য খুঁজে পায়নি পুলিশ! আদালতও ছিল নির্বিকার!

• ২০১১ সালে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং এ সাধারণ পারস্যের ৫০০ কোটি টাকা মেরে দিয়ে জেলে গিয়ে কয়েক মাস পর বেরিয়ে এসেছে। তার আর কিছু হয়নি। শত শত কোটি টাকা মেরে দিয়ে কয়েক মাসের জেল খেটে মুক্তি পাওয়া গেলে, কে করবে না সেটা?

• ২০১৬ সালে একবার চেক প্রত্যাখ্যান মামলায় গ্রেফতার হয়েছিল সাহেদ। কিন্তু নানা পর্যায় থেকে তদবিরের কারণে এক সপ্তাহর মধ্যে বেরিয়ে আসেন তিনি। সেই প্রভাবশালী কারা পত্রিকায় তাদের কথাও এসেছে।

• সাহেদকে ভয়ঙ্কর প্রতারক উল্লেখ করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে ২০১৬ সালে তৎকালীন পুলিশ মহাপরিদর্শককে চিঠি দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। কিন্তু কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এর অধীনে চাকুরী করা পুলিশ মহাপরিদর্শক এর চিঠি আমলে নেন না, চমৎকার না?

• রিজেন্ট হাসপাতালে যখন অভিযান চালানো হচ্ছে তখন সেই খবর পেয়ে শাহেদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে সরাসরি ফোন করেছিল এটা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নিজেই মিডিয়াকে জানান। তিনি তাকে কোন সাহায্য করতে অপারগতা প্রকাশ করেন বলে বলেছেন। এমন একজন প্রতারকের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে ফোন করার স্পর্ধা এই সরকারের আমলেই হয়।

এই সাহেদই আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন ২০১৬ সাল থেকে। সর্বসাম্প্রতিক কমিটিতে সাহেদ ছিলেন না, কিন্তু দলের প্রতি প্রভাবশালী এক সদস্যের সাথে তিনি নিয়মিত বর্তমান কমিটির বৈঠকেও যেতেন।
একটা রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্রের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করে রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকে ভেঙেচুরে, সমাজের বীভৎস সব প্রতারককে কিভাবে দলীয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের সহায়তায় একজন মোটামুটি ক্ষমতাবান মানুষে পরিণত করে মো. সাহেদ সেটা আমাদেরকে দেখিয়ে দিলেন। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা সবকিছু এক যোগ হয় সাহেদের পক্ষে কাজ করেছে, বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে।
এই দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে যে বিভৎস রকম অনিয়ম-দুর্নীতি ঢুকে গেছে, এবং সেসব করেও মানুষ যেমন বহাল তবিয়তে থেকে যায়, তাতে খুব যৌক্তিকভাবেই অনুমান করা যায় – এই সব মানুষের পেছনে ক্ষমতাসীন দল সমস্ত রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে মদদ দেয়। ঠিক যেমন একেবারে অন্যায়ভাবে আমাদের দলের সর্বোচ্চ থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন চালায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে অবৈধভাবে ব্যবহার করে। দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো ন্যূনতম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারলেও এই পরিস্থিতি হতো না।
সাহেদের বিরুদ্ধে হটলাইন চালু করা হয়েছে, ভুক্তভোগী মানুষ যেন তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দিতে পারে। আমাদেরকে নিয়মিতভাবে জানানো হচ্ছে – কতটি অভিযোগ জমা পড়ল। সবকিছুর একটাই উদ্দেশ্য – সাহেদকে এক বিরাট দানব বানিয়ে তোলা আমাদের সামনে। ‌ সরকারের আমাদের বোঝাতে চাইছে সাহেদই যত নষ্টের গোড়া। কিন্তু টিআইবি যেমন বলেছে আমরাও তেমনি জানি, সাহেদ চুনোপুঁটির বেশি আসলে কিছুই না।
সাহেদ গ্রেফতার হওয়ায় সরকারের যেমন লাভ আছে, লাভ আছে আমাদের‌ও। আগে যেমন সম্রাট জি কে শামীম এবং পাপিয়াকে গ্রেফতার করে সরকার সেসবকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে শুদ্ধি অভিযান বলে প্রোপাগান্ডা চালাতে পেরেছে, সাহেদকেও সেরকমভাবে ব্যবহার করার চেষ্টা হচ্ছে। বছরের পর বছর এসব ফালতু নাটক দেখে এই দেশের মানুষ এখন ক্লান্ত, এসব প্রোপাগান্ডায় কাজ হয় না আর। মানুষ খুব ভালোভাবেই জানে এদের বলির পাঁঠা বানানো হয়েছে, তাও সেটা অতি স্বল্প সময়ের জন্য। এরা স্বরূপে ফিরে আসবে খুব দ্রুতই।
সাহেদের গ্রেফতার আমাদের একটা লাভ আছে। এরকম একজন ‘চুনোপুঁটি’ সাহেদ কিভাবে তৈরি হয় সেটা নিয়ে আমাদের নিজস্ব যৌক্তিক অনুমান ছিল। তার গ্রেফতারের পর সেটা আমাদের সামনে প্রকাশ্য হয়েছে, প্রমাণিত হয়েছে। তার জীবনের যে কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ আমি এখানে করলাম আর তার ফেসবুকে ভরে থাকা দেশের সব মহলের প্রভাবশালীদের সাথে তোলা ছবি তার উত্থানের পথ ও পদ্ধতির গল্প বলে যাবে আরও বহুকাল।
— লেখক জাতীয় সংসদ সদস্য ও আইনজীবী।
আরো পড়ুন