প্রতিবেশী সম্পর্কের ‘সালাহউদ্দিন’ ফ্যাক্টর

বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্কের প্রধান ইস্যুগুলো এতটা আলোচিত হয়েছে এক নিঃশ্বাসে অনেকে বলে দিতে পারবে। ধরুন তিস্তার পানি চুক্তি; এটি হয়ে গেলে দুই দেশের সম্পর্কে যতটা প্রভাব ফেলত এখন পর্যন্ত তা না হয়ে মানুষের মনে তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য শীর্ষ কর্মকর্তারা এক যুগে এটি নিয়ে বহু প্রতিশ্রুতি প্রদান করেছেন এবং অনায়াসে তা ভঙ্গ করেছেন। শেষ পর্যন্ত এর প্রতি মানুষের আগ্রহ যখন চূড়ায় তখন দেশটির সরকার এটিকে আলোচনার টেবিল থেকেই বাদ দিয়ে দিলো। সীমন্ত হত্যা আরেকটি ইস্যু, যেখানে মানুষ হত্যা বন্ধ করার অঙ্গীকার করে ভারত। কাজের ক্ষেত্রে সীমান্তে তাদের বিএসএফ ওইসব অঙ্গীকারের কোনো মূল্য দেয় না। ক’দিন বাদে সীমান্তে বাংলাদেশীদের লাশ পড়া অব্যাহত থাকে।

বাণিজ্য ঘাটতি বৃদ্ধি, এ দেশের পণ্যের ওপর এন্টি ডাম্পিং প্রয়োগ, পেঁয়াজের মতো নিত্যপণ্যের অভাব দেখা দিলে, উজানের পানি প্রত্যাহারের মতো আচরণ দেশটি গ্রহণ করে; আর আমাদের দেশে এক কেজি পেঁয়াজের দাম ৩০০ টাকা ছাড়িয়ে যায়। আরো ডজনখানেক ঘোরতর ইস্যু থাকার পরও দুই দেশের সম্পর্কে নতুক একটি ফ্যাক্টর যোগ হয়েছে, যা সামনে জোরালোভাবে উত্থাপিত হবে। দেশ দু’টির বন্ধুত্ব পুনঃনির্ধারণে ভবিষ্যতে সম্ভবত এটি সবচেয়ে প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। তা হচ্ছে, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের ভারতের দীর্ঘ বন্দিত্ব ও বিচার।

ভারতে অবৈধভাবে অনুপ্রবেশের দায়ে দেশটির সরকার তার বিরুদ্ধে মামলা করে। বিচারে নিম্ন আদালতে তিনি নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার পর নরেন্দ্র মোদি সরকার এই রায়ের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে আপিল করে। দীর্ঘ বিচারিক প্রক্রিয়ায় সালাহউদ্দিন চূড়ান্তভাবে নির্দোষ প্রমাণ হয়েছেন। দেশে ফিরে আসতে তার বাধা নেই, তবে সে দেশে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন এ দেশের সরকারের মতোই আচরণ করায় তার দেশে ফেরা বিলম্ব ঘটছে।

ইস্যুটি বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের জন্য উদ্বেগের। যে কোনো কারণে এ দেশের প্রধান রাজনৈতিক নেতাদের কাউকে ধরে নিয়ে ভারতে ফেলে আসলে ভারত সরকার কি তার প্রতি ‘সালাহউদ্দিনের বিচারনীতি’ গ্রহণ করবে? দেশে ক্ষমতার পালাবদল হলে বিএনপি ক্ষমতায় না এসে অন্য কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলেও প্রথমে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় তারা ভারত সরকারের কাছে তা জানতে চাইবে।

সালাহউদ্দিনকে এমন একটা সময় মেঘালয়ের শিলংয়ে উদভ্রান্তের মতো পাওয়া গেল যখন বাংলাদেশের মানুষ তার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল। তিনি তখন বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ছিলেন। ২০১৫ সালের সরকারবিরোধী আন্দোলন তখন তুঙ্গে। আন্দোলনকারীরা চরম নিপীড়নের মুখে পড়ছিলেন। রাজনৈতিক নেতারা প্রকাশ্যে তাদের কার্যক্রম চালাতে পারছিলেন না। সালাহউদ্দিন তখন বিরোধী রাজনীতির প্রধান মুখপাত্র ছিলেন। বিরোধীদের যাবতীয় কর্মসূচি তিলি অজ্ঞাত স্থানে থেকে ঘোষণা করছিলেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণের কারণে প্রকাশ্যে কেউ আসতে পারছিলেন না; তাই বাধ্য হয়ে তাকে অজ্ঞাতস্থানে আশ্রয় নিয়ে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে হয়েছিল।

এই অবস্থায় ২০১৫ সালের ১০ মার্চ রাজধানীর উত্তরা থেকে সালাউদ্দিন নিখোঁজ হন। দীর্ঘ ৬২ দিন তিনি গুম থাকার পর ওই বছরের ১১ মে শিলংয়ে উদভ্রান্তের মতো ঘোরাঘুরির সময় ভারত সরকার তাকে আটক করে। বাংলাদেশে তখন উচ্চহারে গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ করছিল স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলো। সালাহউদ্দিন প্রধান বিরোধী দল বিএনপি থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য ও পরে যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন। তার এই উচ্চ পোর্টফোলিও এবং দেশের রাজনৈতিক টালমাটাল পরিস্থিতি বিবেচনায় বিরোধীদের মুখপাত্র গুম হয়ে গেছে এই বিষয়টি ভারত সরকারের কাছে অজ্ঞাত থাকার কথা নয়।

প্রতিবেশী দেশের একজন উচ্চ পদস্থ ব্যক্তি যে কোনো গণতান্ত্রিক দেশে সমাদার না পাক মামলার শিকার হওয়ার কথা নয়। সরকারের আইন অনুযায়ী মামলা হতে পারে। কিন্তু পরিস্থিতি বিবেচনায় সেই দেশের উচ্চ সরকারি কর্মকর্তারা বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিতে পারতেন। ভারতের প্রেক্ষিত থেকে উদাহরণ দিলে সালাহউদ্দিনের বিরুদ্ধে মামলার বিষয়টি কতটা সৌজন্যমূলক হয়েছে সেটা কিছুটা আমরা অনুমান করতে পারব। মেঘালয়ের ন্যাশনাল পিপলস পাটির নেতা ও রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা কিংবা তার মন্ত্রী পরিষদের গুরুত্বপূর্ণ একজন সদস্য বাংলাদেশের ভেতরে এভাবে উদভ্রান্ত অবস্থায় পাওয়া গেল, তার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কি সিদ্ধান্ত নেবেন? পরিস্থিতি যদি এমন থাকে যে, তিনি দেশে রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্দোলনরত ছিলেন। রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে কব্জায় নিয়ে সেই আন্দোলনে বিরোধীদের সব ধরণের অধিকার হরণ করেছে সরকার। কেবল মাত্র রাজনৈতিক বিরোধিতার কারণে তাদের বিরুদ্ধে চলছে গুম ক্রস ফয়ারের মতো নৃশংস ঘটনা। ধরে নিলাম মেঘালয় অত্যন্ত ছোট একটি রাজ্য তার সাবেক মুখ্যমন্ত্রী কিংবা সহযোগীকে আমাদের দেশের নিরাপত্তা বাহিনী চিনতে পারেনি। তার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হয়ে গেল, কিন্তু বিষয়টি সরকারের উচ্চ মহলে জানাজানি হওয়ার পর তাদের অন্তত নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার কথাই আমরা ভাবতে পারি। নিম্ন আদালতে হেরে যাওয়ার পর উচ্চ আদালতে পিটিশন দায়ের করার প্রশ্নই আসে না।

আমাদের সীমান্তে বড় রাজ্য পশ্চিম বঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিংবা তার কোনো ডেপুটির এ হাল হলে আমরা নিশ্চই তাকে সসম্মানে যত্ন আত্তি করতাম এতে কোনো সন্দেহ থাকার কথা নয়। তবে এটি যদি বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কিংবা তার প্রধান সহযোগী অমিত শাহের ভাগ্য ফেরের ঘটনা হত, তাহলে সেটা কেমন হতো। বোঝাই যাচ্ছে এই পর্যায়ের নেতারা ভাগ্যের ফেরে নির্যাতিত হয়ে নিজের অজান্তে আমাদের সীমান্তে ঢুকে গেলে আমরা তাদের সম্মান করতাম, মর্যাদা দিতাম।

বাংলাদেশ ভারত সীমান্তে বর্তমান সরকারের আমলে আরো বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে যেগুলোকে বিভিন্ন পর্যায় থেকে ওঠা মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগের সাথে সম্পৃক্ত পাওয়া যায়। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ। এ দেশে গণতন্ত্র বার বার লাইনচ্যুত হয়ে যাচ্ছে। এ দেশের নিরাপত্তা বাহিনীকে ক্ষমতাসীনরা অন্যায়ভাবে ব্যবহার করে। এই আমলে কিছু বাংলাদেশী লোক নিখোঁজ হয়েছেন তাদের ঠিকানা হয়েছে ভারতে। কাউকে কাউকে ভারতে জেলে পর্যন্ত পাওয়া গেছে। গুমের পর দীর্ঘ বিরতি দিয়ে একটি দেশের নাগরিক অন্যদেশের সরকারি হেফাজতে পাওয়া যাচ্ছে। এই রহস্য উদঘাটনে কোনো পদক্ষেপ নেই। অথচ এই সময়ে বাংলাদেশের সাথে ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বেড়েছে। সাধারণ মানুষের মনে তাই স্বাভাবিক প্রশ্ন জাগে তাহলে বিচারবঞ্চিত এসব লোকদের হারিয়ে যাওয়া নিয়ে কেন ভারতের পক্ষ থেকে কোনো অনুসন্ধান নেই। যেসব নাগরিককে এ দেশে নিপীড়ন করা হচ্ছে তারা আবার ভারতে গিয়েও একই নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিচারের এক সাক্ষীর ক্ষেত্রে এমনটি ঘটেছে। তিনি প্রথমে সাঈদীর বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য বাছাই হয়েছিলেন। পরে তিনি সিদ্ধান্ত নেন আদালতে সাঈদীর পক্ষে বলবেন। তখন প্রকাশ্যে তাকে বাংলাদেশের আদালত প্রাঙ্গণ থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। দীর্ঘদিন পরে তার খোঁজ মেলে ভারতের কারাগারে। ফটোসাংবাদিক কাজল ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার এরাও নিখোঁজ হয়েছিলেন। কাজল দীর্ঘদিন নিখোঁজ থাকার পার সীমান্তের কাছে থেকে উদ্ধার হন। ফরহাদ মজহারকেও সীমান্তের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, এ অবস্থায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি পক্ষ তাকে উদ্ধার করে।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক পালাবদল হওয়া একটি স্বাভাবিক ব্যাপার। ক্ষমতা হারানোর পর অনেকেই সালাহউদ্দিনের পরিণতি নিয়ে শঙ্কিত হতে পারেন। একটি বৃহৎ দেশ আমাদের তিন দিক দিয়ে ঘিরে রয়েছে। দেশটি দরিদ্র হলেও তার বিশাল আয়তন ও বিপুল জনসংখ্য বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে এখন গুরুত্ব বহন করে। এটা দেশটির প্রতিবেশীর ওপর প্রভাব খাটানোর পথকে সহজ করে দেয়। কিন্তু এই সুযোগটিকে তারা যদি কেবল মাত্র জোর খাটানোর জন্য কাজে লাগায় সেটা এ দেশের নেতাদের জন্যও উদ্বেগের কারণ ঘটায়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তন হলে বিষয়টি নতুন সরকার সামনে আনতে বাধ্য হবে অদূরভবিষ্যতে নিজেদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কারণে। বোঝাপড়ার টেবিলে ভারতের কাছ থেকে এ প্রশ্নটির সুরাহা তারা আগে করে নিতে চাইবে। ভারতের প্রতি তাদের প্রশ্নটি হবে, ‘সীমান্তে কখনো আমাদের উদভ্রান্ত অবস্থায় পেলে আপনারা চিনতে পারবেন তো আমাদের?’ না আমাদের বিরুদ্ধে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা করে, পীড়নকে আরো কঠোর করে তুলবেন, রাজনৈতিক ব্যক্তি হিসেবে গণ্য না করে অসম্মান ও লাঞ্ছনা আরো বাড়িয়ে দিবেন।

[email protected]

আরো পড়ুন