‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করা হবে’
ক্ষমতায় টিকে থাকতে সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ‘হাতিয়ার’ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার ভয়ে আজ জাতির কণ্ঠ রুদ্ধ। বিএনপি শুরু থেকেই বলে এসেছে এই আইন সংবিধান বিরোধী এবং জনগণের কণ্ঠরোধ করার জন্য সরকারের হাতিয়ার। অবিলম্বে এই আইনটি বাতিল করা উচিত। বিএনপি ক্ষমতায় গেলে আইনটি অবশ্যই বাতিল করা হবে।
শুক্রবার সকালে রাজধানীর উত্তরার বাসা থেকে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব এসব কথা বলেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, বিশ্লেষণ করলে দেখতে পাবেন, সরকারি দলের লুটেরাদের বিরুদ্ধে কথা বললে, রাজনৈতিক মত প্রকাশ করলে, সরকারের সমালোচনা করলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করা হচ্ছে। এমনকি যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন তাদের কোনো দুর্নীতির কথা, তাদের কোনো বিবেক বর্জিত কীর্তিকলাপের কথাও যদি সোশ্যাল মিডিয়াতে অথবা প্রিন্টিং মিডিয়াতে প্রকাশ করে তাহলে সেই সাংবাদিক বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহন করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সাংবাদিকসহ সবাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা করার পরেও ৯৪ শতাংশ মামলা হয়েছে এই বিতর্কিত ’৫৭ ধারায়। জারি হওয়ার দুই বছরের কম সময়ের মধ্যেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রতিক্রিয়া বেশ লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠছে। এটাও মনে রাখা দরকার যে, এই আইন কোনো বিচ্ছিন্ন বিষয় নয়। দেশে চলমান মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ প্রক্রিয়ারই একটা অংশ। যখনই কোনো সরকার কর্তৃত্ব পরায়ন হয়ে উঠে, স্বৈরাচারী হয়ে উঠে, ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র পরিণত করতে চায় তখনই প্রথম সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ওপর এবং একই সঙ্গে সোশ্যাল মিডিয়াকে দমন করে। সেটাই এই সরকার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে, সচেতনতার সঙ্গে করে চলেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরলে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহবানও জানান ফখরুল।
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ২০১৮ সালের ৯ অক্টোবর থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কার্যকর রয়েছে। মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর তথ্য মতে, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে এই আইনে ১৫৩ জনের বিরুদ্ধে মামলা করে হয়রানি করা হয়েছে। আর্টিকেল ১৯-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ৬৩টি। ২০১৮ সালে ডিজিটাল আইনে ও আইসিটি অ্যাক্ট মিলে মামলা হয়েছে ৭১টি। অন্যদিকে, ২০২০ সালের ২২ জুন পর্যন্ত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হয়েছে ১০৮টি। এসব মামলায় আসামি ২০৪ জন। তাদের মধ্যে সাংবাদিক ৪৪ জন। অন্যান্য পেশায় কর্মরত ও সাধারণ মানুষ ১৬০ জন।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলাগুলোর মূল অভিযোগ হলো, ব্যক্তির মানহানি, আক্রমনাত্মক মিথ্যা বা ভীতি প্রদর্শন কিংবা রাষ্ট্রের তথ্য-উপাত্ত প্রেরণ, প্রকাশ করা, ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করা। সবাই নিশ্চয়ই অবগত আছেন, এই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা প্রতিনিয়ত কিভাবে বিরোধীদলীয় কিংবা ভিন্নমতাবলম্বীদের সম্মানহানি করছে, কিভাবে আক্রমণাত্মকভাবে মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করছে, কিভাবে ভয়ভীতি প্রদর্শন করছে। এই সরকারের মন্ত্রী-এমপি-আমলা-পুলিশের লুটপাট কিভাবে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি বা সুনাম ক্ষুণ্ন করছে। এ সরকারের নেতাকর্মীদের করোনা সার্টিফিকেট বিক্রির কারণে ইতালিতে বাংলাদেশ থেকে আগত কোনো ব্যক্তিকে এখন প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। নিউইয়র্ক টাইমসে নেতিবাচক প্রবন্ধ হয় বাংলাদেশকে নিয়ে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের শীর্ষ দেশগুলোতে বাংলাদেশ উঠে আসে শীর্ষে। এসবের জন্য, বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও সুনাম ক্ষুণ্নের জন্য তাহলে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পরিপন্থী কর্মকাণ্ড বা সংবিধান লঙ্ঘনের দায়ে কি তাহলে এই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা দণ্ডিত হবেন না? তাদেরকে দায়ী করা সম্ভব হবে না? সরকার কি কোনোভাবে দায় এড়াতে পারে?
২০২০ সালে জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত ১২ জন সাংবাদিককে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়েছে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ইতিমধ্যে সংবাদপত্র, সম্পাদক পরিষদ তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করে করে বলেছেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আেইন-২০১৮‘র জন্য সাংবাদিকরা স্বাধীনভাবে লিখতে পারছেন না। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই কালো আইন বাতিলের দাবি তুলেছে। আমাদের অনেক প্রতিথযশা সম্পাদক যাদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা দিয়ে তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার পরোয়ানাও জারি করা হয়েছে এবং তাদেরকে আদালতে গিয়ে জামিন নিতে হয়েছে। এই আইনে নগ্ন শিকার হয়েছেন তার মধ্যে ৮৫ বছরের বেশি বয়স্ক সম্পাদক আসাদউদ্দিন, সাংবাদিক কাজল ফকির, নেত্র নিউজের সম্পাদক তাসনিম খলিল, ব্যবসায়ীসহ অজস্র নিরহ নাগরিক। অবিলম্বে তাদের নিঃশর্ত মুক্তি দাবি করছি। আমরা মানবজমিনের প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী ও প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান সাহেবসহ অন্যান্য সকলের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত এসব মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।
বিএনপির মহাসচিব পরিসংখ্যান তুলে ধরে বলেন, সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ডিজিটাল আইনে মামলা হয়েছে মোট ৩২৭টি। জানুয়ারি মাসে মামলা হয়েছে ৮৬টি। এর মধ্যে থানায় ৪১টি, আদালতে ৪৫টি। ফেব্রুয়ারি মাসে ১১৯টি মামলা হয়েছে। থানায় ৯৫টি, আদালতে ৩৪টি। মার্চ মাসে মামলা হয়েছে ১২২টি। এর মধ্যে থানায় ৭৫টি, আদালতে ৩৭টি। আগের বছর ২০১৯ সালে মোট মামলা হয়েছে ১ হাজার ১৮৯টি। এর মধ্যে থানায় ৭২১টি, আদালতে ৪৬৮টি।
মির্জা ফখরুল জানান, ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত ৫৫০টির মতো মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন মামলা আছে ১ হাজার ৯৫৫টি। ৫৫টি মামলা হাইকোর্টের নির্দেশে স্থগিত আছে। তিনি বলেন, সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে অনেক মামলার খবর সংবাদমাধ্যমে আসে না। তাই মানবাধিকার সংগঠনগুলোও মামলার খোঁজ পায় না। ফলে সেখানকার চিত্র আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশে একটি মাত্র সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনাল আছে এবং তা ঢাকায়। এতেই বোঝা যায়, নাগরিকদের ন্যায়বিচার পাওয়া কতটা দুরূহ।
বিএনপির ক্ষমতায় গেলে আইনটি বাতিল হবে জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, জনগণের ভোটে বিএনপি কখনো ক্ষমতায় এলে যেসব আইন মানুষের অধিকার খর্ব করে, মানুষের বাক ও চিন্তার স্বাধীনতা হরণ করে, সেসব অবশ্যই বাতিল করবে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলে বিএনপির পক্ষ থেকে সরকারকে কোনো চিঠি দেয়া হবে কিনা বা কোনো কর্মসূচি নেবেন কিনা-এমন এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, গত ৫ মাস ধরে কোভিড-১৯ এর কারণে জনসমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সে কারণে এই মুহূর্তে কোনো কর্মসূচিতে যাইনি। তবে সরকারকে চিঠি দেয়া, তাদের অবগত করানোর চেষ্টা করা- সেটা তো আমরা এর আগেও করেছি, এখনও আমরা করব।