ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই- আবু সায়েম

সংগ্রাম ডেস্ক: এখনো ভাবছেন, সম্প্রীতির মন্ত্র জপলেই মুক্তি মিলবে? সরকারের কোন ভুল ধরিয়ে দিবেন না? অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন না? মুখ বুজে সব অনিয়ম মেনে নিবেন? ভুলে যাবেন, দেশে কোন নির্বাচন হয়নি, ম্যান্ডেট ছাড়াই আপনার আমার ওপর কর্তৃত্ব খাটাচ্ছে কিছু উদ্ধত অপদার্থ? আর তাহলেই সরকার আপনাকে করোনা থেকে বাঁচাবে? হাঁচি-কাশি দিলেই অ্যাম্বুলেন্স এসে যত্ন করে হাসপাতালে নিয়ে ভেন্টিলেটর পরিয়ে দিবে? সঞ্চিত খাদ্য ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই সরকারি ছাত্র-যুব সংগঠনের ত্রাণকর্মীরা ঘরের দরজায় কড়া নাড়বে চিকন চালের বস্তা হাতে?

আপনি ঘোরের মধ্যে বাস করছেন। কখনো শুনেছেন, পিশাচের সাথে কাজকন্যার সংসার হয়? আরব্য রজনীতেও নয়। আমার প্রিয় মাতৃভূমি রূপকথার কঙ্কাবতীর চেয়েও সুন্দর। রাক্ষস থাবা মেলেছে তার বুকে।

আচ্ছা কভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়েছে কবে থেকে? জানুয়ারি মাসের গোড়ার দিকে নয় কি? সরকারকে বারবার সতর্ক করার পরও কী শুনেছে দেশবাসী? “করোনাভাইরাস ছোঁয়াচে নয়, এটা সর্দি-জ্বরের মতো। করোনা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। করোনা ভয়ঙ্কর শক্তিশালী, আমরা তার চেয়েও শক্তিশালী। শেখ হাসিনা আল্লাহওয়ালা মানুষ, দেশে করোনা আসবে না। প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে দেশ করোনামুক্ত রয়েছে। করোনা প্রতিরোধে উন্নত দেশের চেয়ে বাংলাদেশে প্রস্তুতি ভালো। করোনা নিয়ে বিএনপি জনগণকে আতঙ্কিত করছে।” ইত্যাদি ইত্যাদি। মনে মনে নিশ্চয়ই গালি দিচ্ছেন, এগুলো পুরনো কথা তাই। পারবেনতো ঐ একটাই- পক্ষেরই হন বা প্রতিপক্ষের। হ্যাঁ পুরনো রেকর্ড বাজাচ্ছি। কেন জানেন? তা নাহলে আমাদের বিবেক, বোধশক্তি ঘুমিয়ে থাকে। সেকেন্ডে আমরা ভুলে যাই এইমাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা। বারবার স্মরণ করিয়ে না দিলে আপনাদের উপলব্ধির জায়গাটা ভোঁতা হয়ে থাকবে।

আতশবাজির কথা ভুলে গেছেন, তাই না? সারাবিশ্ব যখন লকডাউনের পথে হাঁটছিলো, তখন তারা মুজিববর্ষ পালনের নামে পটকা ফুটিয়ে উৎসব করেছে, ভুলে গেছেন? কত টাকা খরচ হয়েছিলো, জানেন? খোঁজ নিয়ে দেখুন। চারশত কোটি টাকার অফিসিয়াল বাজেট যোগাতে শুধু জানা পথেই ব্যাংকগুলো থেকে চাঁদাবাজি হয়েছে ১০০ কোটি টাকা। এগুলো কি তাদের বাপের টাকা, না শশুরবাড়ির যৌতুক। প্রতিটি পয়সা আপনার আমার আমানত। কে তাদের অধিকার দিয়েছে গ্রাহকের সঞ্চয়ে হাত দেওয়ার? সরকারের করোনাপ্রস্তুতির সমালোচনা করলে আইসিটি আইনে মামলা ধরিয়ে দেয়, মেরে ফেলার ভয় দেখায়, পেটায়, জেলে পুরে দেয়- এসব খবর কি কানে আসেনি?

থাক, ধরেই নিলাম পাবলিক খারাপ। তো সিঙ্গাপুরের চেয়ে উন্নত দেশে পিপিই নেই কেন; ভেন্টিলেটর, করোনা টেস্টের কিটস গেল কোথায়? ডাক্তারদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাচ্ছে না কেন? এখন কেন অর্থনৈতিক মন্দার ভয় দেখানো হচ্ছে? করোনার রোগী নেই, অথচ বাংলাদেশ ছেড়ে পালাচ্ছে বিদেশীরা! এ লেখা যখন লিখছি তখন ৮৫০ জন ব্রিটনকে উড়িয়ে নিতে চার্টার্ড রেসকিউ বিমান প্রস্তুত। এ খবর নিশ্চিত করেছেন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাই কমিশনার স্বয়ং। তারা কেন শেখ হাসনার ঐশ্বরিক ক্ষমতার ওপর বিশ্বাস রাখতে পারছে না?

ডাক্তার মঈনের মৃত্যুর পরে আপনারা সবাইতো কান্নাকাটি করে সোশ্যাল মিডিয়া ভাসিয়ে দিয়েছেন। গরীবের চিকিৎসকের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন অবশ্যই যথার্থ। ওপার থেকে দেখার সুযোগ থাকলে ডাক্তার তার মৃত্যুকে সার্থক মনে করবেন। কিন্তু ঘটনার মূলে ঢুকেছেন কজন? এ নিয়ে ভেবেছেন কি? আদৌ বুঝতে পেরেছেনতো সহজ সমীকরণটা? কেন এত বড় ডাক্তার হয়েও মঈন আইসিইউ পেলেন না? আপনি হয়তো আশা করছেন, বশ্যতা স্বীকার করলেই পার পেয়ে যাবেন। সরকার আপনাকে করোনা থেকে বাঁচাবে। বোকার স্বর্গে আছেন। শুনুন তবে। আপনি যদি সীমান্তের দালাল না হন, আপনি যদি গণতন্ত্র ফিরে পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন, আপনি যদি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনার মুক্তি নেই- সে করোনা থেকে হোক আর ডেঙ্গু থেকে। আপনার মঙ্গলচিন্তা ঘিরে থাকে যদি ৫৬ হাজার বর্গমাইল, তাহলে আপনি তাদের টার্গেট। আবরারকে ভুলে গেছেন? মাত্রতো ছটা মাস গেল। মনে করিয়ে দিতে গেলেইতো তেড়ে আসবেন পুরনো কাসুন্দি বলে। ফেনী নদী, সমুদ্রবন্দর, হাইওয়ে, সুন্দরবন কিছুই কি আছে আর আমাদের? ভাবছেন, প্রাণটা অন্তত আপনার নিজের। না, সেটাও আপনার নয়। সেটার সমাধি কীভাবে ঘটবে তাও তাদের প্রোগ্রামিং করা। মুক্তির কোন পথ নেই। মরলেও আপনার লাশের উপর জুতা মারবে তারা। আপনার সন্তানরা নিরবে কাঁদবে আর চোখের পানি মুছবে, টু শব্দটিও করতে পারবে না।

সবাই শুধু ‘মাননীয়’ ‘মাননীয়’ জপছে দিনরাত। সুশীল, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, পত্রিকাওয়ালা, পেশাজীবী, গুন্ডা-মাস্তান, আন্ডা বাচ্চা, টুপিপরা মৌলানা সবার জিহ্বা ঝুলে পড়ছে ‘মাননীয়’ বলতে বলতে। গত নির্বাচনে অংশ নেওয়া শ্রদ্ধেয় এক বড় ভাইতো রীতিমতো কান্নাকাটি করে ফেলেছেন ‘মাননীয়’র দরবারে! কী মুশকিল! চারদিকে যেন ‘মাননীয়’র রোল পড়ে গেছে। ‘মাননীয়’ও এখন মজা পেয়ে গেছেন বুঝে- এ ভুলোমন, দয়ার সাগর জাতি তাকে মাননীয় বানিয়েই ছেড়েছে। তিনি পবিত্র, সব পাপতাপের ঊর্ধ্বে।

স্বাস্থ, পররাষ্ট্র, তথ্য, বাণিজ্য কাদের হাতে- এ নিয়ে আপনাদের অনেক মাথাব্যথা। পিপিই পিপিপি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ঢাকা কলেজ হয়ে গেলে আপনাদের খুব গোস্বা লাগে। মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা প্রতিদিন নতুন নতুন শাড়ি পরেন বলে আপনারা ট্রল করেন। কিন্তু ভোট ছাড়া গদিতে যিনি বসে আছেন তিনি আপনাদের অন্নদাত্রী, সবার কাছে পূতপবিত্র! তাকে নিয়ে কারো কোন বিকার নেই। “খালেদা জিয়ার মুক্তির সমাগম থেকে ভাইরাস ছড়িয়েছে, তাই বিএনপির কোন অধিকার নেই করোনা নিয়ে কথা বলার”… আপনি ভাবতে বসেছেন, চিন্তার বিষয়তো! তবে কি বিএনপিই দায়ী? যারা উদার মনে স্বীকার করেন অন্যায়গুলো, তারাও আবার বলতে ছাড়েন না, ‘এগুলো সভাসদদের বুলিমাত্র।’ ‘মাননীয়’ থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে। সংসদে দোয়ামাহফিল হয়েছে দেখেছেন নিশ্চয়ই। তথৈবচ, খালি ‘মাননীয়’র গুণকীর্তন। কেউ কেউ বলছেন, ‘মাননীয়’ নাকি খুব একা। কারণ, তিনি মহান আর তার চারপাশে কেবল চোর-বদমাশ। আহা! জানতাম ‘Queen can do no wrong.’ ভেবেছিলাম, কেবল রাণী এলিজাবেথেরই প্রাপ্য সেটা। ভোটবিহীন নির্বাচনের পালের গোদাও যে তার ঊর্ধ্বে, বাংলাদেশে না জন্মালে বুজতাম না। কচিকাচারাও জানে, বাংলাদেশে ভালো থাকতে হলে ‘মাননীয়’কে খুশি রাখতে হয়। তার ওপর সীমান্তের আশীর্বাদ আছে।

আচ্ছা, একজন সাধারণ মানুষের সাথে সরকারপ্রধানের পার্থক্য কোথায়? দ্বিতীয়জনের মর্যাদা ও ক্ষমতা বেশি। কিন্তু সেটাতো জনগণের নেতা হলে। কিন্তু যিনি জনতার প্রতিনিধি নন, যিনি প্রতারণা করে গদি দখল করে আছেন, তার মর্যাদাতো রাস্তার কুলিমজুরের চেয়ে নিচে হওয়ার কথা। একজন ভিক্ষুকও খেটে খায়, আর অবৈধরা বেআইনিভাবে দেশ চালায়। তার মানে আইনের দৃষ্টিতে তারা অপরাধী-তস্কর। সভ্য দুনিয়ায় এদের ঠাঁই হতে পারে না। ন্যায়বিচারের পাল্লা নিখুঁতভাবে ওজন দিলে ‘মাননীয়’ ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের রেশন খেয়ে বেঁচে থাকার কথা। মাথা খাটানতো, ‘মাননীয়’র চ্যালা কারা? ত্রাণচোর, ক্যাসিনোব্যবসায়ী, চাঁদাবাজ, খুনি, লুটেরা। চাল চুরিতে সারাদেশে এপর্যন্ত কতজন ধরা খেয়েছে? তারা কাদের লোক? তা সত্ত্বেও ‘মাননীয়’ কাদেরকে দিয়ে ত্রাণ বন্টনের ঘোষণা দিয়েছেন? আপনি পাবেনতো? এ ‘মাননীয়’র নিশ্বাসে কিন্তু রাক্ষসের বিষ। যতই হাত কচলান না কেন লাভ হবে না। সাধারণ মানুষের এসএমএস পেয়ে তাদের বাড়িতে তিনি খাদ্য পাঠিয়ে দেন, এমন বক্তব্য শুনে তারে বোগদাদের হারুনুর রশিদ ভেবে ভুল করে বসবেন না।

দেখুন, সমস্যা কিন্তু আপনার আমার। কী ভাবার কথা আর কী নিয়ে মগজ কচলাকচলি করছি আমরা! গালি দিচ্ছি স্বাস্থ্য, পররাষ্ট্র, তথ্য কিংবা বাণিজ্যকে। অথচ তারা হুকুমের চাকরমাত্র। যা আদিষ্ট হয়, তা-ই বলে। কলকাঠি নাড়ে কিন্তু ‘মাননীয়’। হাবভাবে মনে হচ্ছে, ‘মাননীয়’র দরবারে মুরিদ বনে গেছে সবাই।

অনেকে বলবেন, এটা সময়ের তাগিদে খানিকটা সমঝোতা। না, সমঝোতা ও আপোসকামিতার মধ্যে পার্থক্য আছে। গণমানুষের বৃহত্তর কল্যাণের লক্ষ্যে অবশ্যই সন্ধি করা যেতে পারে। পৃথিবীর সবচেয়ে মহৎ ও অনুকরণীয় সন্ধির কথা কে না জানে- হুদায়বিয়ার সন্ধি। সেটির লক্ষ্য ও অর্জন কী ছিলো, ভেবে দেখেছেন কখনো? কিন্তু যখনই আপনি আপোসকামিতার পথে হাঁটতে শুরু করবেন, তখনই সর্বনাশ। উঠতে বসতে ২৪ ঘন্টা মুখে ‘মাননীয়’ জপতে থাকা আপোসকামিতার লক্ষন। ভয় পেলে চুপ মেরে যান, ঢোল পিটিয়ে একজন অবৈধকে ‘মাননীয়’ ‘মাননীয়’ করতে হবে কেন?

‘মাননীয়’ নয়, আমার আপনার ঘাড়ে বসে আছে এক রাক্ষস। আপনি করোনা থেকে মুক্তি পেলেও এ রাক্ষসের হাত থেকে নিস্তার পাবেন না। কত মানুষ মারা যাবে কভিড-১৯ এ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার আশঙ্কা অনুযায়ী (শুদ্ধতা যাচাই করা হয়নি), সর্বোচ্চ বিশ লক্ষ। কিন্তু রাক্ষসের খাঁচায় বন্দি থেকে মরে আছে ১৮ কোটি মানুষ।

‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু’ হয়ে মুক্তি মিলবে না।

ব্যারিস্টার আবু সায়েম
লন্ডন ১৯/০৪/২০২০

[নোট: লেখার শিরোনাম রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর কবিতা থেকে নেওয়া।]

আরো পড়ুন