রাজনীতিতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের সততা ও দেশপ্রেম এক অনন্য দৃষ্টান্ত

মো. সহিদুল ইসলাম সুমন:

দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ। একজন ঈমানদার মানুষের মধ্যে দেশপ্রেম থাকা অপরিহার্য। দেশপ্রেম ও সততা শব্দ দুটি একে অন্যের পরিপূরক। যে দেশপ্রেমিক সে অবশ্যই সৎ। আবার যে ব্যক্তি সৎ তার মধ্যে অবশ্যই দেশপ্রেম আছে। একজন প্রকৃত নেতার মধ্যে অনেক গুণাবলি থাকা আবশ্যক। তার মধ্যে দেশপ্রেম ও সততা অন্যতম।
সততা ও দেশপ্রেমের কারণেই শহীদ জিয়া আমাদের প্রিয় নেতা ও জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ছিলেন একজন আপদ মস্তক সৎ রাষ্ট্র নায়ক, যার সততা ও দেশপ্রেম ইতিহাসে অনন্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। সততা আর দেশপ্রেমই ছিল জিয়াউর রহমানের মূল শক্তি।

জিয়াউর রহমানের প্রধান পরিচিতি ছিল একজন সৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে, সেখান থেকে রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে তিনি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাক-ব্যক্তিস্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করেন। দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে আমৃত্যু চেষ্টা চালিয়েছেন। জাতির মধ্যে একটি নতুন উদ্দীপনার সৃষ্টি করে তাদেরকে জাগিয়ে তুলতে তিনি সফল হয়েছিলেন। তার স্বল্পকালীন শাসনকার্য পরিচালনায় তিনি যে গভীর দেশপ্রেম, সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন তা আজো কেউ অতিক্রম করতে পারেনি। এমনকি তার রাজনৈতিক বিরোধী ও কট্টর সমালোচকরাও মৃত্যুর পর তার সততা ও দেশপ্রেম নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করতে পারেনি। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান এ কারণেই এ দেশের জনগণের অন্তরে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন।

ব্রিটেনের বিশ্বখ্যাত সাবেক প্রধানমন্ত্রী ‘আয়রন লেডি’ নামে খ্যাত ব্যারোনেস মার্গারেট থ্যাচার তাঁর মৃত্যুর আগে অনুরোধ রেখে গিয়েছিলেন যেন তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় স্কটল্যান্ডের দেশপ্রেমিক কবি রবার্ট বার্নসের একটি গান পরিবেশিত হয়। সেটি ছিল, ‘আই প্লেজ টু দ্য, মাই কান্ট্রি’। অর্থাৎ ‘হে আমার দেশ, আমি তোমার কাছে অঙ্গীকারবদ্ধ হলাম’। থ্যাচার বিতর্কিত, কিন্তু তাঁর নিখাদ দেশপ্রেম সম্পর্কে দ্বিমতের অবকাশ ছিল না। বাংলাদেশের মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দেশ ও জাতির কাছে সেভাবেই অঙ্গীকারবদ্ধ হয়েছিলেন, তাঁর প্রিয় গান ছিল, ‘প্রথম বাংলাদেশ, আমার শেষ বাংলাদেশ/জীবন বাংলাদেশ, আমার মরণ বাংলাদেশ’। এ গানটি তাঁকে উদ্বুদ্ধ করত। তাঁর সঙ্গে সঙ্গে যেন সমগ্র জাতিও এতে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশের সেবায় এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। (সূত্র: স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র সুরক্ষায় জিয়ার অবদান-ইনাম আহমদ চৌধুরী: অর্থনীতিবিদ, উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ)

বিশিষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট মোহাম্মদ আবদুল গফুর তার এক প্রবন্ধে উল্লেখ করেন ‘যারা সারাজীবন কোনো দিন ক্ষমতা পাওয়ার কথা ভাবেননি, কেবল জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করে গেছেন, তাদের চোখেও জিয়া ছিলেন নায়ক। যেমন, মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী। তিনি জিয়াউর রহমানকে সীমাহীন মূল্য দিতেন। মওলানা ভাসানী অনেক সময় তার নিজের দলের লোকদের বিরুদ্ধে কথা বললেও জিয়াউর রহমান সম্বন্ধে কোনোদিন সমালোচনা করেননি। আমি নিজে একবার মওলানা ভাসানীকে এ বিষয়ে বলেছিলাম, হুজুর, আপনি অনেক সময় নিজের দলের লোকদের সমালোচনা করেন, কিন্তু আপনাকে কখনও জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করতে দেখিনি, এর কারণ কী? মওলানা সাহেব বলেন, দেখ আবদুল গফুর, তুমি তো রাজনীতি দেখছো অনেক দিন ধরে, আর আমি দেখছি তোমার চেয়েও বেশিদিন ধরে। তুমি আমাকে এমন একজন লোকের নাম বলো, যে জিয়ার মতো সৎ, নির্দোষ ও দেশপ্রেমিক। সত্যই মওলানা ভাসানীর একথার মধ্যে এতটুকু অতিরঞ্জিত কিছু নেই। মানুষ হিসেবে জিয়ার সততা ছিল তুলনাহীন। দেশকে, দেশের মানুষকে জিয়া কত ভালোবাসতেন, তার তুলনা ছিল না। জিয়া রাজনীতি করেছেন, তবে তার রাজনীতির মধ্যে ক্ষমতার অপব্যবহার যেমন ছিল না, তেমনি ছিল না সম্পদ গড়ে তোলার চিন্তা। একারণে দেশের মানুষও তাকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতো’ (প্রবন্ধ : জিয়া ছিলেন সৎ ও দেশপ্রেমিক নেতা)

জাতীয় পার্টি দলীয় এমপি এ.কে.এম মাঈদুল ইসলাম মুকুল তার লেখা ‘আত্মসত্তার রাজনীতি এবং আমার ভাবনা’ শীর্ষক গ্রন্থে লিখেছেন (তিনি জিয়াউর রহমানের কেবিনেটের সদস্য ছিলেন ) জিয়াউর রহমান নিজে ছোট একটি গাড়ি ব্যবহার করতেন। যে গাড়িটি ব্যবহার করতেন তাতে এয়ারকন্ডিশন ছিল না, এটা তেমন কোন দামি গাড়িও ছিল না। তাঁর নিরাপত্তার জন্য আজকের মতো আগে-পিছে, ডানে-বামে দামি গাড়ির বহর ছিল না। খুবই সাধারণ। সামনে একটি পুুলিশের গাড়ি থাকত। একজন সার্জেন্ট আর তার সাথে কিছু পুলিশ।

জিয়াউর রহমান সাহেব মন্ত্রীদের বলেছিলেন, আপনারা কখনও সিগন্যাল অমান্য করবেন না, আইন কানুন মেনে চলবেন।
একবারের একটি কথা মনে আছে। প্রেসিডেন্ট সাহেব রাজশাহী থেকে ঢাকা আসার উদ্দেশ্যে সড়ক পথে রওয়ানা হলেন। এডিসি সাহেব মারসিডিজ গাড়ি পাঠিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট সাহেব গার্ড অব অনার নিয়ে ফিরে এসেই দেখেন যে সেখানে মারসিডিজ গাড়ি প্লেস করা আছে। এটা দেখে তিনি এডিসি সাহেবের ওপর চটে গেলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, এ গাড়ি কে পাঠিয়েছে? এডিসি সাহেব বললেন, এমএসপি সাহেব পাঠিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট জিয়া রাগান্বিত হয়ে তার বেতনের টাকা থেকে গাড়ির তেলের টাকা কেটে রাখার নির্দেশ দিলেন। পরে তিনি ডিসি সাহেবকে তার গাড়িটি প্লেস করার কথা বললেন এবং ফেরিঘাটের রাস্তাটি দেখার জন্য ডিসি সাহেবের সেই ছোট গাড়িটি নিয়ে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিলেন।

একদিন প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সাহেব কেবিনেট মিটিংয়ে মন্ত্রীদের উদ্দেশ্যে বললেন, দেখেন আমি বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট। আমার দেশ খুবই গরিব দেশ। পৃথিবীর সবাই তা জানে। আমাকে সি অফ করার জন্য বা রিসিভ করার জন্য এতোগুলো লোক এবং এতো গাড়ি বিমানবন্দরে আসা-যাওয়ার দরকার হয় না। এসব অপব্যয় বিদেশিরা দেখেন এবং তারা মনে করেন, তাদের পয়সা দিয়ে এসব অপব্যয় করা হচ্ছে। রাত্রিবেলা আপনারা যখন আমাকে রিসিভ করে ফিরেন, তখন মনে হয় যেন বিমানবন্দরে আগুন লেগে গেছে। সব লোক পালাচ্ছে। গাড়ির বহর একসাথে বের হচ্ছে। সুতরাং এখন থেকে শুধুমাত্র স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সাহেব যাবেন।

বিশ্বের সফল ও বরেণ্য রাষ্ট্রনায়ক অনেকেই রয়েছেন। কিন্তু স্বল্প সময়ের মধ্যে সদ্য স্বাধীন হওয়া একটি দরিদ্র ও অনগ্রসর দেশ; যা রাজনৈতিক অনিশ্চয়তায় দোদুল্যমান, তাতে স্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে একটি গণতান্ত্রিক কাঠামোতে তাকে স্থাপন করে, দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সুদৃঢ় করে, উন্নয়নের রাজপথে তাকে চলমান করিয়ে দেওয়ার কৃতিত্ব শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া ছাড়া বিশ্বের ইতিহাসে খুব বেশি কারও আছে বলে আমার জানা নেই।

তাই তো রাষ্ট্রপতি জিয়ার শাহাদাতের পর ১৯৮১ সালের জুনের প্রথম সপ্তাহে কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েট আয়োজিত এক সভায় তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে কমনওয়েলথের তদানীন্তন মহাসচিব স্যার সিদ্ধার্থ রামফাল বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্রপতি জিয়া বাংলাদেশে শুধু একদলীয় রাজনীতির পরিবর্তে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই প্রতিষ্ঠা করেননি; এ উন্নয়নকর্মী দেশকে সার্বিক উন্নয়নের রাজপথে পরিচালিত করেছিলেন।’ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে ‘সার্ক’-এর মাধ্যমে ঐক্যের বন্ধনে গ্রথিত করা ছিল তাঁর এক স্বপ্ন। রাষ্ট্রপতি জিয়ার অকালমৃত্যুতে তাঁর দেশ একজন দক্ষ, সৎ সংগঠক ও সফল রাষ্ট্রনায়ককেই শুধু হারাল না, দক্ষিণ এশিয়া হারাল এক দূরদর্শী স্বাপ্নিক অগ্রপথিককে, উন্নয়নশীল দেশ-গোষ্ঠী হারাল এক সৃষ্টিধর্মী নেতা, কমনওয়েলথ হারাল সৌভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতায় বিশ্বাসী এক মহান ব্যক্তিত্বকে।

আজ দেশে যখন সত্য ও ন্যায় সর্বক্ষণ পরাভূত হচ্ছে প্রলোভন ও পরাক্রমের প্রতিকারহীন অপরাধে, যখন আইনের শাসন হয়ে পড়ছে এক বিস্মৃত প্রায় জীবনধারা, আজ যখন সরকারি কর্মকান্ড দুর্নীতির গভীর কন্দরে নিমজ্জিত, আজ যখন দেশের পুরো অর্থনীতি গভীরতম খাদের কিনারায়, হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার করেছে লুটেরা, আজ যখন স্বৈরাচারী কায়দায় দেশে গণতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে, আজ যখন বাংলাদেশের সব চেয়ে জনপ্রিয় ব্যাক্তিত্ব, তিন তিন বারের প্রধানমন্ত্রী, আপোসহীন নেত্রী, এদেশের গণতন্ত্রের মা দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে মিথ্যা মামলায় কারাগারে বন্দী করে রাখা হয়েছে এবং তাকে তার মৌলিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, আগামীর রাষ্ট্র নায়ক জনাব তারেক রহমানকে মিথ্যা মামলায় দিয়ে দেশান্তরিত করে রেখেছে, বিরোধী দলের হাজার হাজার নেতাকর্মীকে হত্যা গুম ও মিথ্যা মামলা দিয়ে কারান্তরীণ করে রাখা হয়েছে। ঠিক সেই সময় শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও তার নেতৃত্বের কথা খুব মনে পড়ে।

এখন আমাদের আশা, বর্তমান অচলাবস্থা নিরসনের জন্য শাসক গোষ্ঠীর শুভ বুদ্ধির উদয় হবে এবং একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করে তাদের অধীনে সাধারণত নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন এবং বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি ও সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করবেন।

আগামী দিনে রাষ্ট্রপতি জিয়ার সুযোগ্যা ও স্বার্থক উত্তসুরী, তারুণ্যের অহংকার, আগামীর রাষ্ট্র নায়ক ও এ জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক জনাব তারেক রহমান এই সংকটাবস্থা ও দুর্বিষহ জীবন থেকে জাতির মুক্তি জন্য জিয়াউর রহমানের মতো এ জাতিকে যোগ্য নেতৃত্ব দিয়ে উত্তরণের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন, এটাই আমাদের প্রত্যাশা ও বিশ্বাস ।

লেখক : মো: সহিদুল ইসলাম সুমন
বি.এস.এস (সম্মান) এম.এস.এস (অর্থনীতি), এমবিএ, এল এল বি।
সাবেক ছাত্রনেতা, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
Email : [email protected]

আরো পড়ুন