রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি তলানিতে
রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি নিয়ে আমাদের সরকার সদাসর্বদাই তটস্থ থাকে। করোনার ভয়াবহতার মাঝেও রাষ্ট্রের তথাকথিত ভাবমূর্তি রক্ষার নামে সরকার আপোষহীন। প্রায়শই গ্রেপ্তার, হাতকড়া, রিমান্ড, আদালত এসব নিয়ে সরকার খুব ব্যতিব্যস্ত থাকে এই ভয়াবহ সংকটেও।
এসব মামলা খতিয়ে দেখলে সাধারণ মানুষকে হেনস্তা করা এবং ভিন্ন মত দমনের আলামত স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কোভিড-১৯ কালেও মামলা করেছে চিকিৎসার লন্ডভন্ড অবস্থা বা ত্রাণ লুটপাট নিয়ে সমালোচনা করার কারণে। সবচেয়ে বেশি মামলা করা হয়েছে মন্ত্রী-সাংসদ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে ফেসবুকে লেখা বা সম্প্রচারের অভিযোগে। এমনকি নবম শ্রেণির ছাত্রকেও আটক করা হয়েছে।
সাংসদ শহিদ ইসলাম পাপুল মানব পাচারের অভিযোগে কুয়েতে আটক হওয়ার পূর্বে কেউ যদি ফেসবুকে লিখে দিত এই সাংসদ মানব পাচারে জড়িত বা টাকার জোরেই সস্ত্রীক সাংসদ হয়েছেন
তাহলে সরকার নিশ্চয় তাকে হাত কড়া পড়িয়ে তাকে আদালতে তুলে রিমান্ডের জন্য আবেদন করতেন এবং শেষ পর্যন্ত তার রাষ্ট্রদ্রোহী হিসাবে বিচার হতো, আর পাপুল সাহেবের ক্ষমতার দম্ভে হয়তো ১৪ পুরুষ বাংলাদেশ থেকে উচ্ছেদই হয়ে যেতো। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে সত্য উদঘাটন করলে কোন ব্যক্তিকে কি রাষ্ট্র সুরক্ষা দেয়!
মানব পাচারকারীর মত জঘন্য অপরাধীকে আমরা চিনতে পারিনি, ধরতেও পারিনি বরং তাকে সস্ত্রীক সাংসদ বানিয়ে উচ্চতম মর্যাদার জায়গা দিয়েছি অথচ বিদেশী রাষ্ট্র আমাদের দেশের নাগরিক পাচারের অপরাধে তাকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে প্রেরণ করেছে।
প্রশ্ন জাগে, কেন আমাদের রাষ্ট্র অনুধাবন করতে পারেনি কী শক্তিবলে একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী ক্ষমতাসীন মহাজোটের প্রার্থীকে নির্বাচনী মাঠ থেকে সরিয়ে দিতে বাধ্য করেছে। কী তার ক্ষমতা, কী তার উৎস ক্ষমতাসীন সরকারি জোটকে চ্যালেঞ্জ করার।
আওয়ামী লীগের মতো দলের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটি একবারও অনুধাবন করলো না, যেই স্বতন্ত্র প্রার্থী তাদের মহাজোটের প্রার্থীকে টাকার জোরে মাঠে থাকতে দিচ্ছে না সেই প্রার্থীর টাকার উৎস কী।
টাকার বিনিময়ে সাংসদ হওয়া যায় এটা সারা বিশ্বে জেনে যাওয়ার পরও বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি কি ক্ষুন্ন হয়নি?
একজন লোক আকস্মিক প্রার্থী হয়ে সস্ত্রীক সাংসদ হয়ে গেলেন কিন্তু রাষ্টীয় কোন সংস্থা তার কোন খবর নিলো না, এ বিস্ময়কর উত্থানের রহস্য সম্পর্কে জানতে চাইলো না।
আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষে চিঠিতে বলা হয় লক্ষীপুর ২ আসনে মহাজোট মনোনীত প্রার্থী মোহাম্মদ নোমান বৃহত্তর স্বার্থে আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী শহিদ ইসলাম এর সমর্থনে প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেছেন। অর্থাৎ মোহাম্মদ নোমান মহাজোটের মনোনীত প্রার্থী থাকলে জোটের বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষিত হতো না, বৃহত্তর স্বার্থ রক্ষিত হয়েছে আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থীর সমর্থনে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে। এখন আওয়ামী লীগ কোনোক্রমে নৈতিকভাবে শহিদ ইসলামকে অস্বীকার করতে পারেনা। কারণ তারা স্বীকার করে নিয়েছেন শহীদ ইসলাম আওয়ামী লীগ দলীয় স্বতন্ত্র প্রার্থী। যদিও বাস্তবে নোমান প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেননি। ব্যালটে প্রার্থী হিসাবে তার নাম ও দলীয় প্রতীক লাঙ্গল ছিল। আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির চিঠিতে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেছেন বলে যা বলা হয়েছে আইনগত ভাবে তা বৈধ নয়। ওই চিঠিতে আরও বলা হয়েছিল, আপনাদের জানা আছে যে শহিদ ইসলাম আওয়ামী লীগের একজন নিবেদিত নেতা ও সক্রিয় মাঠ পর্যায়ের কর্মী। দীর্ঘদিন ধরে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত আছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বৃহত্তর স্বার্থে এ আসনে বিজয় দলের পক্ষে নিশ্চিত করা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে শহিদ ইসলামকে সর্বাত্মক সমর্থন দিয়ে নির্বাচন কমিশনকৃত তাঁর প্রতীকে বিজয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা অতীব জরুরি।
আওয়ামী লীগ নিজেই স্বীকার করেছে শহিদ ইসলাম আওয়ামী লীগের নিবেদিত নেতা, তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে দীর্ঘদিন যাবৎ জড়িত। সে জিততে না পারলে আওয়ামী লীগের বৃহত্তর স্বার্থ ক্ষুন্ন হবে। এখন যখন মাননীয় সংসদ বিদেশে মানব পাচারকারী হিসাবে গ্রেপ্তার তখন আওয়ামী লীগ কোন দায় স্বীকার করছে না। ভয়ঙ্কর তথ্য উন্মোচনের আগ পর্যন্ত দলের নিবেদিত নেতা, সরকারের পূর্ণ সমর্থন তার সাথে থাকে, কিন্তু তথ্য উন্মোচনের পর সমস্ত দায় অস্বীকার করার দ্বিমুখী সংস্কৃতি থেকে অবশ্যই আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। রাজনীতির দ্বিমুখী চরিত্র জনমনে ঘৃণার জন্ম দিচ্ছে।
একজন সাংসদ যখন মানব পাচার ও মুদ্রা পাচারে অভিযুক্ত হয়ে বিদেশে আটক আছেন এবং সে দেশের জাদরেল জেনারেলদের চাকরীচ্যুত এবং গ্রেপ্তার করা হচ্ছে তখন আমাদের দেশে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। কুয়েতের মেজর জেনারেল আল জারাহ ঘুষের বিনিময়ে পাপুলের বেশ কিছু কাজ দ্রুত অনুমোদন করে দিয়েছেন বলে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে এবং তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে টাকার বিনিময়ে তিনি কিভাবে সাংসদ হলেন, কারা টাকা লেনদেনের অবৈধ কাজের সাথে যুক্ত ছিলেন, কারা মানবপাচারের শিকার হয়েছেন, কারা নির্যাতনের শিকার হয়েছেন তা নিয়ে সরকারের কোন ভূমিকাই পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
যে দেশে গত ত্রিশ বছর যাবৎ নারী নেতৃত্ব সেই বাংলাদেশ থেকে নারী পাচার হচ্ছে অহরহ, অথচ আমাদের দেশ কোনদিন বুঝতে পারল না নারী পাচার করছে কারা। বরং যেসব দেশে নারী পাচার করা হচ্ছে, পতিতা বানানো হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে তারাই শেষে ব্যবস্থা নিল। আমরা নারী পাচারকারীকে হয়তো আরো কয়েক যুগ ধরতে পারতাম না। নারী পাচারকারী নিয়ে বিশ্ব মিডিয়ায় তোলপাড় – এতে কি রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় না?
সরকারের স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় কেলেঙ্কারি এখন বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত। পরীক্ষা বিহীন ভুয়া সনদ এর কারণে সারাবিশ্বে বাংলাদেশ আজ ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে পরিচয় লাভ করছে। অনেক দেশের সাথে আকাশ পথ বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। সৌদি আরব স্বাস্থ্যবিধি না মানায় বাংলাদেশ বিমানকে জরিমানা করেছে। ভুয়া সনদ সারাবিশ্বে বাঙালির আত্মমর্যাদাকে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে। এখন যেসকল দেশে প্রবাসীরা রয়েছেন সেসকল দেশেই তারা উপহাসের শিকার হচ্ছে। করোনার ভুয়া সনদের কলংকের সীলমোহর যে ভাবে বাংলাদেশিদের কপালে অঙ্কন করে দেয়া হয়েছে তা বহুদিন বহন করতে হবে। পরীক্ষা বিহীন ভুয়া সনদ দুনিয়াকে নাড়া দিয়ে গেছে কিন্তু সরকারকে নাড়া দেয়নি। আমাদের দেশে কত পাপুল, কত সাহেদ, কত আরিফ বিরাজ করছে তা কেউ তলিয়ে দেখেছি!
ভুয়া সনদ, মানব পাচারকারী, ক্যাসিনো, বাড়িতে টাকার গোডাউন, অতি দ্রুত ধনী হওয়া সবগুলো হয়েছে রাষ্ট্রীয় প্রশ্রয়ে। একটার সাথেও সাধারণ জনগণের কোন সম্পর্ক নাই। এভাবে মানব পাচারকারী, নারী পাচারকারী, টাকা পাচারকারীর বিস্তার ঘটতে থাকলে একদিন আমাদের অলক্ষ্যে সমগ্র রাষ্ট্রই পাচার হয়ে যাবে। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি এখন তলানিতে ঠেকেছে। রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় সরকারের অপশাসনের কারণে জনগণের কারণে নয়। তা বুঝতেও আমরা ব্যর্থ হচ্ছি। আমরা এত বোকা, এত নির্বোধ।
চলুন, নিজের দেশের জনগণের উপর নিপীড়ন না করে ঐক্য বদ্ধভাবে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি উদ্ধারের সংগ্রামে সবাই নিয়োজিত হই।
সাধারণ মানুষের রক্তে রঞ্জিত বাংলাদেশে আবার সাধারণ মানুষ নিপীড়নের শিকার হবে এজন্য মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়নি।
যে রাষ্ট্র ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তে অর্জিত সে দেশের নাগরিক কেন রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করবে। আর পৃথিবীর এমন কোন দেশ কি আছে যেখানে সরকারের ভাবমূর্তি নিয়ে জনগণ প্রশ্ন উত্থাপন করে না। এমন কোন সরকার কি আছে যে সরকারের কোন দুর্বলতা নাই। এমন কোন সরকার কি আছে যে সরকার ঐশ্বরিক এবং অবিনশ্বর!
আমরা কি একবারও তলিয়ে দেখেছি কেন রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্রে পচন ধরেছে। কেন করোনার ভয়ংকরতায়ও আমরা দুর্নীতিতে মেতে উঠেছি। একবারও কি ভেবে দেখেছি মৃত্যু পরোয়ানা হাতে নিয়েও কিভাবে ভুয়া সনদ দেওয়া হচ্ছে। করোনা পরীক্ষায় ভুয়া সনদ প্রদান বিশ্বে বিরল ঘটনা।
এতকিছুর পরও আমাদের বিবেক জাগ্রত হচ্ছে না। আমরা অন্ধ আত্মম্ভরিতাকে বিবেকের জায়গায় প্রতিস্থাপন করে ফেলেছি। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত একটি রাষ্ট্রকে কোথায় নিয়ে গিয়েছি তা কেউ পরিমাপ করছি না।
এগুলো যে আমাদের ক্ষমতালোভী অমানবিক ও অনৈতিক রাজনীতির সংস্কৃতি। রাজনৈতিক সংস্কৃতি এভাবে বিস্তার লাভ করলে রাষ্ট্রনিশ্চয়ই অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে। আর ৩০ লক্ষ শহীদের আত্মা আমাদের অভিসম্পাত দিবে।
পরম করুণাময় আল্লাহ যেন আমাদের জাতীয় নেতৃত্বের সুমতি দেন ও রাষ্ট্রকে যেন হেফাজত করেন।
—
লেখক: গীতিকার
১৫ জুলাই ২০২০.