স্বাস্থ্যখাতের ২ হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে ১০ প্রতিষ্ঠান!
মেডিকেল যন্ত্রপাতির দাম বাজার মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দেখানো ছাড়াও হাসপাতালের বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারের প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে স্বাস্থ্যখাতের কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর এসব প্রতিষ্ঠান গত পাঁচ বছরে স্বাস্থ্যখাতের বেশির ভাগ কাজই বাগিয়ে নিয়েছে বলে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) সূত্রে জানা গেছে।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) বলছে, গত ৫ বছরে ১০টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পেয়েছেন স্বাস্থ্যখাতের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনাকাটার কাজ। এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদফতর ও হাসপাতালের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদেরও যোগসাজশ রয়েছে। ফলে আত্মসাৎ হয়েছে সরকারের কোটি কোটি টাকা।
সময় নিউজের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, শুধু ২০১৭-১৮ অর্থ বছরেই অন্তত ১ হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে স্বাস্থ্য খাতের হাসপাতালের যন্ত্রপাতি কেনায়। যার বেশিরভাগই নিম্নমানের এবং অব্যবহৃত। এমন তথ্য উঠে এসেছে দেশের অন্তত ২৭টি হাসপাতাল ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কেনাকাটা সংক্রান্ত তথ্যে। বিশ্লেষকরা বলছেন, উচ্চপর্যায়ের গাফিলতি না থাকলে এতো বড় অঙ্কের দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাৎ সম্ভব নয়।আবার বেশিরভাগ যন্ত্রপাতিই কেনা হয়েছে চাহিদাপত্র ছাড়াই। ‘এ’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতির মূল্যে সরবরাহ করা হয়েছে ‘সি’ ক্যাটাগরির যন্ত্রপাতি। কখনো কখনো দেশে থেকেই যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে কোনো নামকরা বিদেশি কোম্পানির।
ফরিদপুর মেডিকেলে যন্ত্রপাতির মূল মূল্যের চেয়ে ১৮৬ গুণ বেশি দেখানো হয়েছে। ১৭৫ কেটি টাকার নিম্ন মানের যন্ত্রপাতি কেনা হয় গাজীপুরের শহীদ তাজউদ্দীন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের জন্যও।
শহীদ এম মনসুর আলী মেডিকেলে আড়াইশ’ কোটি টাকা। রংপুর মেডিকেল কলেজে ভারী যন্ত্রপাতির প্রয়োজন না থাকা সত্ত্বেও ৪ কোটি টাকার সার্জিক্যাল ভারী যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এছাড়া হাসপাতালটির বিরুদ্ধে আরও ২০ কোটি টাকা গরমিলের অভিযোগ রয়েছে।
সাতক্ষীরা মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে চাহিদাপত্র ছাড়াই ভুয়া বিল দাখিল করে পিএসিএস সফটওয়্যার সংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতির নামে ৬ কোটি ৬ লাখ টাকা তুলে নেয়া হয়। সাতক্ষীরা ইনস্টিটিউট অব হেলথ টেকনোলজিতে ১১ কোটি ৭৪ লাখ টাকার, ফরিদপুর মেডিকেলে কলেজে অন্তত ৩০ কোটি টাকা, নোয়াখালী মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালে ১৫ কোটি টাকা। নারায়ণগঞ্জ ৩শ’ শয্যার হাসপাতালের ১৯ কোটি ১৪ লাখ টাকা, ঢাকা মেডিকেলে কলেজে ২১ কোটি ৭০ লাখ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজে ৬৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা, ঢাকা ডেন্টাল কলেজে ২৫ কোটি ৭১ লাখ টাকা, মৌলভীবাজার আড়াইশ’ শয্যার হাসপাতালে ১৪ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও তা অব্যবহৃতই রয়েছে। কক্সবাজার মেডিকেলে ভুয়া যন্ত্রপাতির লেবেল লাগিয়ে সাড়ে ৪৮ কোটি টাকার মধ্যে ৩৭ কোটি ৪৮ কোটি টাকাই আত্মসাৎ করা হয়।
টিআইবি বলছে, খাতটির প্রতিটি স্তরে দুর্নীতির কারণে স্বাস্থ্যখাতে টেকসই সেবার মানোন্নয়ন সম্ভব হচ্ছে না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এই লুটপাট প্রক্রিয়াটা প্রতিষ্ঠানের আভন্তরীণ যে সব ঘাটতি আছে সেগুলো অবশ্যই জবাবদিহিতার আওতায় নিয়ে আসা দরকার।
স্বাস্থ্যখাতের এমন চিত্র দুদকের নজরে আনলে দুদক কমিশনার বলেন, সরকারি অর্থ লুটে যারা জড়িত তাদের পদবি দেখা হবে না।
দুদক কমিশনার মোজাম্মেল হক খান বলেন, এক্ষেত্রে রোগের চিকিৎসা না, যিনি ক্রয়কারী তার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কেনা হয়েছে। দুর্নীতির সব ক্ষেত্রে আমরা সর্বদা সেটা মোকাবেলা করার চেষ্টা করি। আমরা যদি সুযোগ পাই তাহেলে অবশ্যই আইনের আওতায় নিয়ে আসব।
দুদক সূত্রে জানা যায়, বক্ষব্যাধি হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্মকর্তা মুন্সী সাজ্জাদ হোসেনের আত্মীয় স্বজনের নামে রয়েছে পাঁচটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান। ঢাকা, ফরিদপুরসহ কয়েকটি সরকারি হাসপাতালে বাজারমূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে যন্ত্রাপতি সরবরাহ করে তার প্রতিষ্ঠানগুলো। অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে তিনি হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় শত কোটি টাকা। সম্প্রতি ১৪ ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তার প্রতিষ্ঠানগুলোও কালো তালিকাভুক্ত করেছে সরকার।
অন্যদিকে ঠিকাদার জাহের উদ্দিন সরকারের নিজ নামে এবং আত্মীয় স্বজনের নামে রয়েছে বেঙ্গল সায়েন্টিফিক, মার্কেন্টাইল ট্রেড এবং ইউনিভার্সেল ট্রেড নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে অতিরিক্ত বিল দেখিয়ে জাহের উদ্দিন প্রায় আড়াইশ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন বলে জানিয়েছে দুদক।
স্বাস্থ্য খাতের সবচেয়ে আলোচিত ঠিকাদার তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী আবজাল হোসেন। তিনি নামে-বেনামে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রহমান ট্রেড, রুলমান ট্রেড ও রূপা ফ্যাশনের মাধ্যমে আত্মসাৎ করেছেন প্রায় ২০০ কোটি টাকা। স্ত্রীসহ আবজাল এখন বিদেশে পলাতক রয়েছেন। স্ত্রীসহ আবজালের বিরুদ্ধে গত বছর অনুসন্ধান শুরু করে দুদক।
দুদকের পাঁচ বছরের তথ্য বলছে, শুধু সাজ্জাদ, জাহের কিংবা আবজাল নয়, স্বাস্থ্যখাতে প্রভাবশালী এমন আরও সাতজন ঠিকাদার রয়েছেন- যাদের সবার বিরুদ্ধেই প্রায় একই অভিযোগ। এমএইচ ফার্মার মোসাদ্দেক হোসেন, ম্যানিলা মেডিসিনের মনজুর আহমেদ, অভি ড্রাগসের জয়নাল আবেদিন, আলভিরা ফার্মেসির আলমগীর হোসেন, এসএম ট্রেডার্সের মোহাম্মদ মিন্টু, পুনম ট্রেড ইন্টারন্যাশনালের নজরুল ইসলাম ও আরসিএস এন্টারপ্রাইজের রবিউল আলমরা বিভিন্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে যন্ত্রপাতির অতিরিক্ত দাম দেখিয়ে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। সব মিলিয়ে পাঁচ বছরে সরকারের গচ্ছা প্রায় দুই হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ৯ জুন মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের উপসচিব হাসান মাহমুদের সই করা এক চিঠিতে এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে কালো তালিকাভুক্ত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে স্বাস্থ্য অধিদফতরকে জানানো হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর এরই মধ্যে ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। প্রতিষ্ঠানগুলো হচ্ছে- রহমান ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও স্বত্ত্বাধিকারী রুবিনা খানম, তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাব রক্ষক মো. আবজাল হোসেনের স্ত্রী; মেসার্স অনিক ট্রেডার্স ও স্বত্ত্বাধিকারী আব্দুল্লাহ আল মামুন; মেসার্স আহমেদ এন্টারপ্রাইজ ও মুন্সী ফররুখ হোসাইন; মেসার্স ম্যানিলা মেডিসিন অ্যান্ড মেসার্স এস কে ট্রেডার্স ও স্বত্ত্বাধিকারী মনজুর আহমেদ; এমএইচ ফার্মা ও স্বত্ত্বাধিকারী মোসাদ্দেক হোসেন; মেসার্স অভি ড্রাগস ও স্বত্ত্বাধিকারী মো. জয়নাল আবেদীন; মেসার্স আলবিরা ফার্মেসি ও স্বত্ত্বাধিকারী মো. আলমগীর হোসেন; এস এম ট্রেডার্স ও স্বত্ত্বাধিকারী মো. মিন্টু; মেসার্স মার্কেন্টাইল ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল ও স্বত্ত্বাধিকারী মো. আব্দুস সাত্তার সরকার ও মো. আহসান হাবিব; বেঙ্গল সায়েন্টিফিক অ্যান্ড সার্জিকেল কোম্পানি ও মো. জাহের উদ্দিন সরকার; ইউনির্ভাসেল ট্রেড করপোরেশন ও মো. আসাদুর রহমান; এ এস এল এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আফতাব আহমেদ এবং ব্লেয়ার এভিয়েশন ও স্বত্ত্বাধিকারী মো. মোকছেদুল ইসলাম।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদ বলেন, ‘দুদক ১৪টি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করতে আমাদের একটি চিঠি দেয়। অর্থাৎ, দুদক থেকে বলা হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে যেন কাজ না দেয়। আমরা সেজন্য তাদের কালো তালিকাভুক্ত করেছি এবং কাজ না দিতে বলেছি। সেইসঙ্গে ভবিষ্যতে যেন তারা আর কোনো কাজ না পায় সেটার ব্যবস্থাও করেছি।’
স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতির বিষয়ে দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে বর্তমান কমিশন প্রতিকার ও প্রতিরোধমূলক বেশকিছু ব্যবস্থা নিয়েছে। ঢাকা, সাতক্ষীরা, রংপুর , চট্টগ্রাম, ফরিদপুরসহ বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা সামগ্রী ক্রয়ে দুর্নীতির অভিযোগেও কমিশন থেকে ১১টি মামলা দায়ের করা হয়। এই ১১টি মামলায় সম্পৃক্ত ১৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালো তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।’
দুদক চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘সংশ্লিষ্ট এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান এখনও শেষ হয়নি। আমরা কাউকে ছাড় দেব না। যারাই দুর্নীতি করবে তাদের সবাইকে আমরা আইনের আওতায় নিয়ে আসব।’
সূত্র: সময়নিউজ/সারাবাংলা