আপনি কেন চা অথবা কফি পান করবেন?

চা, কফি আমাদের খাদ্য তালিকায় প্রায় অপরিহার্য অংশ হয়ে উঠেছে। সমাজের ধনী-গরিব সবার কাছেই এটি জনপ্রিয় পানীয়। কেউ রং চা, কেউ মসলা চা, গ্রীন টি, কফি আবার অনেকের দুধ চা বা দুধ কফি না হলে চলেই না!

আমরা কফি পাই কফি বিচি থেকে। চা পাই চা পাতা থেকে। কফিতে থাকে ক্যাফেইন, ট্যানিন। চায়ে থাকে ক্যাফেইন, ট্যানিন এবং ক্যাটেচিন। ক্যাফেইন হলো উত্তেজক উপাদান। চা পাতায় ৩.৫ এবং কফিতে থাকে ০.৮-২.২ শতাংশ ক্যাফেইন থাকে। এখানে মজার বিষয়, এক কাপ চা তৈরিতে অল্প পরিমাণ চা পাতি লাগে, পক্ষান্তরে এক কাপ কফি তৈরিতে কফির পরিমাণ বেশি থাকে। তাই বলা হয়, কফিতে ক্যাফেইন বেশি।

ট্যানিন অপরিশোধিত ফল, রেড ওয়াইন, চা ইত্যাদিতে থাকে। কফিতে থাকে খুবই সামান্য। লক্ষ্য করে দেখুন- চা পানের পর মুখের মধ্যে যে শুকনো এবং স্নিগ্ধ অনুভূতির সৃষ্টি করে তাই ট্যানিন। এটি অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এটি ক্যাফেইন-এর উত্তেজককে শান্ত রেখে ভারসাম্য তৈরি করে।

ক্যাটেচিন হলো ন্যাচারাল অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কফিতে ক্যাটেচিনের পরিবর্তে ক্লোরোজেনিক এসিড থাকে যা ট্যানিনের রস।

চা, কফি এগুলো নানাভাবে আমাদের দেহ ও মনে প্রশান্তি আনে। যেমন: গ্রীন টিতে ক্যাটেচিন বেশি থাকায় এটি ন্যাচারাল অ্যান্টি অক্সিডেন্টের ন্যায় কাজ করে। ফলে এটি ব্রেন ফাংশনে সহায়তা করে, ফ্যাট বার্ন করে। এ ছাড়া চিনি ছাড়া লেবু, মসলাযুক্ত রং চা, গ্রীন টি এগুলোকে ডিটক্স ওয়াটারও বলে। ওজন হ্রাস, কোষ্ঠকাঠিন্য ও প্রশান্তিমূলক জনপ্রিয় পানীয় এই ডিটক্স ওয়াটার। সর্দি-কাশির ওষুধ হিসেবে প্রাচীনকাল হতে এগুলো ব্যবহার হচ্ছে। পাশাপাশি চা, কফি শারীরিক কর্মক্ষমতা বাড়ায়।  কফি ক্যানসার, টিউমার এমনকি স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। অন্যদিকে দুধ চা ওজন বৃদ্ধি করে।

প্রতিদিন সর্বোচ্চ ১-২ কাপ রং চা, মসলা চা, গ্রীন টি খাওয়া যাবে। ব্ল্যাক কফি এক কাপ। দুধ চা ও দুধ কফি সপ্তাহে ১-২ দিন। গর্ভকালীন ১৬ সপ্তাহ পর্যন্ত চা, কফি এমনকি গ্রীন টি না-খাওয়াই ভালো। মনে রাখতে হবে চা, কফির প্রধান অপরাধী উপাদান হলো ক্যাফেইন। ক্যাফেইনের ক্ষতিকর দিকসমূহ হলো- এটি মূত্রাশয়ের ক্রিয়াকলাপ বাড়িয়ে তোলে। ফলে প্রস্রাবের ফ্রিকোয়েন্সি বাড়তে থাকে। অনেক ক্ষেত্রে বয়স্কদের মধ্যে হাঁচি-কাশিতে প্রস্রাবে কাপড় নষ্ট হয়ে যায়। এটি অতিরিক্ত চা বা কফি পানের ফল। এছাড়া নিদ্রাহীনতাও দেখা দিতে পারে। ক্যাফেইন নেশার ন্যায় অভ্যাস তৈরি করে। যাদের প্রতিদিন চা পানের অভ্যাস, তাদের নির্দিষ্ট সময়ে এটি পান না-করলে মাথাব্যথা, বিরক্তি, ক্লান্তি ও হৃদস্পন্দন বাড়তে থাকে।

এছাড়া অতিরিক্ত ক্যাফেইন গ্রহণে হজমে বাঁধা সৃষ্টি হয় ফলে পেটে গ্যাসের সমস্যা, বমি বমি ভাব ইত্যাদি দেখা দেয়। গর্ভবতী ও শিশুদের জন্য ক্যাফেইন নিষিদ্ধ। মাইগ্রেন সমস্যাতে ক্যাফেইনযুক্ত খাবার পরিহার করা উচিত।

চা এবং কফির আরেকটি উপাদান ট্যানিন। ট্যানিনের জন্য দাঁতে দাগের সৃষ্টি হয়। তাই চা, কফি পানের ১০-১৫ মিনিট পর ভালো করে মুখ কুলকুচি করা উত্তম। মনে রাখতে হবে, পানের পরপরই কুলকুচি করা যাবে না। এছাড়া অতিরিক্ত ট্যানিন খাবার থেকে আয়রণ শোষণে বাধা দেয়। ফলে বেশি চা, কফির জন্য অ্যানেমিয়া হতে পারে।

ফলে মাত্রাতিরিক্ত চা পান করলে মাথা ব্যথা, ঘুমের সমস্যা, হজমের সমস্যা, লিভারের সমস্যা হতে পারে। এটি ধীরে ধীরে মুখের স্বাদ নষ্ট করে ও ক্ষুধামন্দা তৈরি করে।
শরীরে পানিশূন্যতাও দেখা দিতে পারে। এছাড়া চিনিযুক্ত চা, কফি ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়। দুধ চা অ্যাসিডিটি বৃদ্ধি করে।

সুতরাং চা, কফি পানে বেশ কিছু সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। যেমন ইনস্ট্যান্ট কফি কোনো অবস্থাতেই জ্বাল দেয়া যাবে না। চা ২-৩ মিনিটের বেশি জ্বাল দেয়া উচিত না, বিশেষত গ্রীন টি। এতে চায়ের অ্যান্টি অক্সিজেনের গুণ নষ্ট হয়। দুধ চায়ের ক্ষেত্রে দুধ ও চায়ের যৌগটি খেতে সুস্বাদু কিন্তু এর পরিণাম ভালো নয়। কোনো ভারী খাবারের সঙ্গে চা, কফি পান করা যাবে না। এ ক্ষেত্রে খাবারের অন্তত ২ ঘণ্টা পর পান করা যেতে পারে। যাদের অ্যাসিডিটির সমস্যা তারা চা, কফি পানের ১৫-২০ মিনিট পরে পানি খেলে অ্যাসিডিটি কিছুটা কম অনুভূত হয়।

পাশাপাশি আরো কিছু বিষয় মনে রাখতে হবে, কফি গরম পানিতে মিশিয়ে পান করতে হবে। চায়ের ক্ষেত্রে পানি ২ মিনিটের মতো উত্তপ্ত করে ফুটিয়ে চুলা বন্ধ করে সামান্য চা পাতি পানিতে দিয়ে ঢেকে দিতে হবে। এভাবে ২ মিনিট রেখে তারপর কাপে পরিবেশন করতে হবে। চাইলে এরপর আপনি পছন্দ মতো লেবু, মালটা, আদা ইত্যাদি যোগ করতে পারেন। চা, কফিতে চিনির পরিমাণ আপেক্ষিক। স্বাদ মতো নেবেন। তবে স্থূলকায় এবং ডায়াবেটিস রোগীর জন্য চিনি না খাওয়াই ভালো। ডায়াবেটিস রোগীরা শরীরচর্চার পূর্ব চিনিসহ চা পান করতে পারেন।

লেখক: পুষ্টিবিদ, ল্যাব জোন স্পেশালাইজড হসপিটাল

You might also like