বিজয়ের ৫০ বছর: গণতন্ত্র আর উন্নয়নের হিসাব মিলছে কি

গত এক দশকে মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা শব্দগুলো বারবার ব্যবহৃত হয়েছে সরকারের সব অন্যায়-অবিচারকে ন্যায্যতা দিতে, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বয়ান তৈরিতে, যা মানুষকে বিযুক্ত করেছে বিষয়গুলো থেকে, হয়তো ক্ষোভও তৈরি করেছে নিজের অজান্তেই

এরপর একটি জাতীয় নির্বাচনে জয়ের পর ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে হস্তান্তর না করার কারণে আমরা অর্জন করলাম স্বাধীন দেশ। অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে স্বাধীন হয়ে যাওয়া বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানের প্রস্তাবনার তৃতীয় অনুচ্ছেদে তাই আমাদের পূর্বসূরিরা এমন এক রাষ্ট্রের অঙ্গীকার করেছিলেন, যেখানে ‘সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।’

আজ দেশের মধ্যেই সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ মানুষের সঙ্গে বাকি ৯০ শতাংশ মানুষের অর্থনৈতিক বৈষম্য বেড়েছে সেই সময়ের তুলনায় অনেক গুণ। আর রাজনৈতিক, সামাজিক বৈষম্য তো আমাদের বিবেচনায় আসার মতো খারাপ ছিল না, সেটা গত এক দশকের বেশি সময়ের অপশাসনের কারণে এখন অকল্পনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। সুষ্ঠু নির্বাচন, ভোটাধিকার প্রয়োগ, নিজের পছন্দের প্রতিনিধি নির্বাচন এবং বিনা প্রতিবাদে সেই জনরায়কে মেনে নেওয়া এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে তা না হলে একটি দেশ ভেঙে নতুন দেশ তৈরি হতে পারে। যেকোনো প্রসঙ্গে ’৭০ সালের নির্বাচনের কথা এলে আমার আজও অবাক লাগে, ইয়াহিয়ার মতো একজন ঘৃণিত সামরিক স্বৈরশাসকের অধীনও একটা অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচন কীভাবে হয়, যেখানে বঞ্চিত-শোষিত পূর্ব পাকিস্তানের কোনো দল ১৬৭টি আসন পেয়ে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে!

যে গণতন্ত্রকে মূলমন্ত্র ধরে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছিল, সেই দেশে গত এক যুগে চালু হয়েছে, ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’, ‘সীমিত গণতন্ত্র’, ‘বেশি উন্নয়ন কম গণতন্ত্র’, ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ নামক অদ্ভুত সব স্লোগান। ঠিক যেমন আইয়ুব খানের ‘বনিয়াদি গণতন্ত্র’। সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খান তাঁর অবৈধ ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার বয়ান হিসেবে উন্নয়নকে বেছে নিয়েছিলেন।

গণতন্ত্রের সূচক প্রকাশকারী ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, ফ্রিডম হাউস, বেরটেলসম্যান স্টিফটুং, ভি-ডেম, ইনস্টিটিউট ফর ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ইলেকটোরাল অ্যাসিস্ট্যান্স, মানবাধিকার নিয়ে কাজ করা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, নাগরিক স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা সিভিকাস, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কাজ করা রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, আইনের শাসনের সূচক প্রকাশকারী ওয়ার্ল্ড জাস্টিস প্রজেক্ট, দুর্নীতির সূচক প্রকাশকারী ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, নির্বাচনের মান নিয়ে সূচক প্রকাশ করা ইলেকটোরাল ইন্টেগ্রিটি প্রজেক্টের গত কয়েক বছরের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের যে চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, তা কেবল হতাশাজনক নয়, উদ্বিগ্ন হওয়ারও যথেষ্ট কারণ আছে।

যে গণতন্ত্রকে মূলমন্ত্র ধরে একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছিল, সেই দেশে গত এক যুগে চালু হয়েছে, ‘আগে উন্নয়ন পরে গণতন্ত্র’, ‘সীমিত গণতন্ত্র’, ‘বেশি উন্নয়ন কম গণতন্ত্র’, ‘উন্নয়নের গণতন্ত্র’ নামক অদ্ভুত সব স্লোগান। ঠিক যেমন আইয়ুব খানের ‘বনিয়াদি গণতন্ত্র’। সামরিক স্বৈরাচার আইয়ুব খান তাঁর অবৈধ ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার বয়ান হিসেবে উন্নয়নকে বেছে নিয়েছিলেন।

বাংলাদেশের জন্মলগ্নে দুই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যই মূল উপজীব্য হিসেবে কাজ করেছে। আজকের বাংলাদেশে সেই বৈষম্য এতটাই প্রকট যে ধনী আরও ধনী এবং দরিদ্র আরও দরিদ্র হওয়ার চক্রে পড়ে বৈষম্য পরিমাপক জিনি সহগ প্রায় ০ দশমিক ৫-এ পৌঁছেছে, যা তীব্র বৈষম্য নির্দেশ করে। ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক অতিধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে প্রথম, আর ৮ কোটি থেকে ২৫০ কোটি টাকার সম্পদের মালিক ধনী বৃদ্ধির হারে বাংলাদেশ বিশ্বে তৃতীয় হলেও, দরিদ্র মানুষের সংখ্যার বিচারে বাংলাদেশ বিশ্বে পঞ্চম।

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালনের এই ঝলমলে সময়ে দাঁড়িয়ে যখন ক্ষমতাসীন সরকার জোর গলায় উন্নয়নের ফিরিস্তি দিতে ব্যস্ত, তখন মনে হলো দেখে আসি আমাদের সঙ্গে পরাজিত হওয়া পাকিস্তান কেমন করছে এখন। যা দেখলাম তাতে বিস্ময়ের চেয়ে কষ্ট হলো বেশি। কিছু উদাহরণ দিলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে। যেমন ১. দুর্নীতির ধারণা সূচক—বাংলাদেশ ১৪৬, পাকিস্তান ১২৪। ২. মুক্ত গণমাধ্যম সূচক—বাংলাদেশ ১৫২, পাকিস্তান ১৪৫। ৩. নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা, ইলেকটোরাল ইন্টেগ্রিটি প্রজেক্ট—বাংলাদেশ ৩৮ পয়েন্ট, পাকিস্তান ৪৭ পয়েন্ট। ৪. গ্লোবাল নলেজ ইনডেক্স—বাংলাদেশ ১১২, পাকিস্তান ১১১। ৫. সহজে ব্যবসা সূচক—বাংলাদেশ ১৬৮, পাকিস্তান ১০৮। ৬. মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশন—বাংলাদেশ ২০টির মধ্যে লাল সূচক ১৬টি ক্ষেত্রে, পাকিস্তান ১১টি ক্ষেত্রে। ৭. মুঠোফোনে ডেটা স্পিড—বাংলাদেশ ১৩৪, পাকিস্তান ১১০। ৮. টাইমস হায়ার এডুকেশন বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাঙ্কিং ২০২১—এক হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আছে পাকিস্তানের ১১টি, বাংলাদেশের মাত্র ১টি।

সদ্য মুক্তি পেয়েছে লাল মোরগের ঝুঁটি। সিনেমাটি দেখলাম। গুণী পরিচালকের দক্ষ পরিচালনায় তৈরি সিনেমাটি সব দিক দিয়ে অনবদ্য। এর কাহিনিও আমাদের গতানুগতিক মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার বাইরে। সে কারণেই ভেবেছিলাম হলে উপচেপড়া ভিড় না থাকলেও অনেক মানুষ এটি দেখবেন। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, হলে আমিসহ ১০ জনের বেশি দর্শক নেই। গত এক দশকে মুক্তিযুদ্ধ, চেতনা শব্দগুলো বারবার ব্যবহৃত হয়েছে সরকারের সব অন্যায়-অবিচারকে ন্যায্যতা দিতে, ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার বয়ান তৈরিতে, যা মানুষকে বিযুক্ত করেছে বিষয়গুলো থেকে, হয়তো ক্ষোভও তৈরি করেছে নিজের অজান্তেই। আর সে কারণেই হয়তো এ বিষয়ের ওপর তৈরি হওয়া একটি চমৎকার সিনেমাও দর্শক টানতে পারছে না। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে দাঁড়িয়ে জাতির জন্য এর চেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয় আর কী হতে পারে?

রুমিন ফারহানা বিএনপিদলীয় সাংসদ ও হুইপ এবং বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

You might also like